পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ একে অপরের সহ-নাগরিক। একে অপরের ব্যথা বোঝা, সম্মান দেওয়া, সমান চোখে দেখা— এ মানবিক গুণগুলোই প্রকৃত সভ্যতার পরিচায়ক। কিন্তু আমরা দিবস নির্ভর সম্মানের এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি।
নারী দিবস এলেই স্তুতির বন্যা, পুরুষ দিবসে কিছু শুভেচ্ছা বার্তা, শ্রমিক দিবসে সংহতির গান, শিক্ষক দিবসে কৃতজ্ঞতার ফুল। অথচ বছরের বাকি দিনগুলোতে কী হয়? যে নারী কর্মজীবনে অসামান্য অবদান রাখেন, তিনি অফিসে হয়রানির শিকার হন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে উপেক্ষিত হন, পরিবারের বোঝা হয়ে থাকেন।
প্রতিটি দিবসের পেছনে স্বতন্ত্র কিছু ঘটনা সূতিকাগার হিসেবে থাকে। সে ঘটনা কারণ যেমন আধিপত্যবাদের দমন-পীড়ন, ঠিক একইভাবে দিবস উদযাপনকেই মহত্ত্বের খাতায় তুলতে গড়ে ওঠে কিছু পূঁজিবাদী আধিপত্যের খেলা। ফলে অনেক উন্নতি, প্রগতি, সম্ভাবনা দেখা গেলেও আদতে তা থেকে যায় মেটাফোরিক; আবেগের খেলা ও একটি বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনা।
নারী দিবস এলেই শহরজুড়ে জমে ওঠে উদযাপনের আমেজ। পথঘাটে স্লোগান, ব্যানারে দৃপ্ত ঘোষণা— ‘নারীর ক্ষমতায়নই উন্নয়নের মূলমন্ত্র।’ কর্পোরেট দুনিয়া যেন এই একটি দিনে নারীদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ ছাড়, অফার, উইমেন স্পেশাল আয়োজন। অফিসে একগুচ্ছ প্রশংসাবাক্য, সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র, সোশ্যাল মিডিয়ায় স্তুতির বন্যা। অথচ এ উদযাপন কি সত্যিই নারীর শক্তিকে স্বীকার করার, নাকি তাকে অলঙ্কারের মতো সাজিয়ে রাখার এক অভিনব কৌশল?
সম্মান যদি প্রকৃত হয়, তবে তা বিশেষ কোন দিনে সীমাবদ্ধ হতে পারে না। যে সমাজ সত্যিকারভাবে ন্যায় ও সমতার আদর্শে চলে, সেখানে নারী বা পুরুষকে আলাদা করে সম্মান জানানোর প্রয়োজন পড়ে না। সেখানেই মানুষ মানুষ হিসেবে মর্যাদা পায় কেবল তার মানবিক গুণাবলির জন্য, কোনো লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য নয়।
নারীর ক্ষমতায়ন বলতে আজ আমরা যা বুঝি, তা অনেকটাই একটি অলংকারের মতো, যা প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়, ব্যবহারিক প্রয়োগে নয়। আমরা নারীকে উচ্চপদে বসাই, কিন্তু তার সিদ্ধান্তের মর্যাদা দেই না। আমরা নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেই, কিন্তু তাদের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চাই। নারীর নামের সঙ্গে শক্তি, দুর্জয়, অপরাজিতা শব্দ জুড়ে দেই, কিন্তু তাকে নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ স্বাধীনতা দেই না।
ক্ষমতায়ন তখনই হবে, যখন এটি অলংকার হয়ে থাকবে না, বরং বাস্তবতায় রূপ নেবে। নারী পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সে একজন স্বতন্ত্র সত্তা। যার সম্মান ও মর্যাদা কোন বিশেষ দিনে নয়, প্রতিদিন নিশ্চিত করতে হবে।
নারী দিবস, পুরুষ দিবস, শিশু দিবস—এতসব আলাদা আলাদা পরিচয়ে মানুষকে ভাঙার প্রয়োজন কী? কেন আমরা একে অপরের ব্যথাকে নিজের ব্যথার সমান অনুভব করতে পারি না? যদি পৃথিবী সত্যিই বৈষম্যহীন হতো, তবে নারী দিবসের মতো আলাদা এক দিনের প্রয়োজন পড়ত না। বরং প্রতিটি দিনই হত মানুষের দিন। যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান সুযোগ পেত, একই সম্মান পেত, একে অপরের সহযোগী হিসেবে পথ চলতে পারত।
আজ নারীর সম্মান বিশেষ দিনে একটি ফুলের তোড়া বা অভিনন্দন বার্তার মধ্যে আটকে আছে। অথচ এ সম্মান তখনই প্রকৃত হবে, যখন প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় তাকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হবে। কেবল নারীর জন্য নয়, প্রতিটি মানুষের জন্য এ ন্যায্যতা নিশ্চিত করা দরকার।
সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে নারী-পুরুষ বিভক্তির গণ্ডি ভেঙে ফেলতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন বলে আলাদা স্লোগান না তুলে আমাদের বলতে হবে— মানুষের ক্ষমতায়ন চাই। মানুষ হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার জন্য নারীকে বিশেষ সম্মানিত হতে হবে কেন? বরং একে অপরের সম্মান নিশ্চিত করাটাই সভ্যতার প্রকৃত মানদণ্ড হওয়া উচিত।
পৃথিবী তখনই সত্যিকারের সুন্দর হবে, যখন একে অপরকে প্রতিযোগী নয়, সহযোগী ভাবা হবে। নারী দিবস, পুরুষ দিবস নয়—প্রতিটি দিন হোক মানুষের।