Homeদেশের গণমাধ্যমেনতুন বছরে বাংলাদেশ-ভারত ‘আস্থার ঘাটতি’ কমবে কি?

নতুন বছরে বাংলাদেশ-ভারত ‘আস্থার ঘাটতি’ কমবে কি?


বন্ধুপ্রতিম দুই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে সাম্প্রতিক নানা ইস্যুতে শীতলতা তৈরি হয়েছে। সেই রেশ নিয়েই শেষ হচ্ছে ঘটনাবহুল একটি বছর। বিদায়ী বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে ভারতের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পর পাল্টাপাল্টি বিভিন্ন ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে আস্থার টানাপড়েন চলছে উল্লেখ করে কূটনীতিকরা বলেছেন, নিজেদের স্বার্থেই নতুন বছরে দুই দেশেরই এই আস্থার ঘাটতি কমিয়ে আনার ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। তারা বলছেন, এখন উভয়পক্ষেরই সংযম এবং নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, ঢাকা সুসম্পর্ক চায়, তা পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতেই হবে এবং এটিই সঠিক বার্তা।

গেলো ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশে ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার’ অভিযোগ তোলে ভারত। তবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের এমন মন্তব্য ভালোভাবে নেয়নি ঢাকাও। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষও ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভারতের পতাকা অবমাননার অভিযোগ তোলা হয় ভারতের পক্ষ থেকে। যদিও বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এর সত্যতা পাননি বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে উল্লেখ করা হয়। অপরদিকে ভারতীয় গণমাধ্যমেও বাংলাদেশ নিয়ে একের পর এক বিদ্বেষমূলক সংবাদ প্রকাশ করা হয়— যা এই তিক্ততায় ঘি ঢালে। একপর্যায়ে ভারতের কলকাতা ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশন ও সহকারী হাইকমিশনে হামলা চালানো হয়। অবমাননা করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকারও। বিতর্কিত মন্তব্য করেন ভারতের শীর্ষপর্যায়ের নেতারাও। সবমিলিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি প্রকাশ্যে আসে।

সাবেক কূটনীতিকরা মনে করছেন, দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং আস্থার ব্যবধান কমিয়ে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ফলে দুই দেশের জাতীয় স্বার্থে কোনও পরিবর্তন হয়নি। একমাত্র যে পরিবর্তনটি দৃশ্যমান তা হলো— রাজনৈতিক বোঝাপড়ার অভাব। এবং এর সমাধান করা জরুরি। ভারতকে এই বাস্তবতা বুঝতে ও মেনে নিতে হবে যে, শেখ হাসিনা আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন। একইসঙ্গে ঢাকাকে তার লাভ-ক্ষতি ও ঝুঁকি বিশ্লেষণের মূল্যায়ন করতে হবে ভারতের সঙ্গে আলোচনার আগে।

সাবেক এক কূটনীতিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে ও পরে ভারতের সঙ্গে সৃষ্ট সম্পর্কের পরিবর্তন রাজনৈতিক। এটা কোনও গোপন বিষয় নয় যে, ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক বোঝাপড়া ছিল। ভারত সরকারের প্রাথমিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বোধগম্য। তারা শেখ হাসিনাকে প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল, কিন্তু চার মাস পরও হ্যাং ওভার এখনও শেষ হয়নি। তারা এখনও অপরিণত আচরণ দেখাচ্ছে।’

রাজনৈতিক সম্পর্ক

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুই দেশের বহুমাত্রিক সম্পর্কের পারস্পরিক নির্ভরতার কারণে ভারতকে বাংলাদেশের প্রয়োজন এবং এর বিপরীতটাও ঠিক। ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু এবং বাংলাদেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘু। বাংলাদেশের কিছু অংশে ভারতবিরোধী মনোভাব রয়েছে, ঠিক যেমন ভারতে হিন্দুদের মধ্যে মুসলিমবিরোধী মনোভাব রয়েছে।

বৈশ্বিক পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ভারত চতুর্থ বৃহত্তম শক্তি, বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এছাড়া ভারত বিশ্বের একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।

কূটনীতিতে দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি হলো ইতিহাস এবং অন্যটি হলো ভৌগোলিক অবস্থান। এই কারণেই যেকোনও দেশ তার প্রতিবেশীকে অনেক গুরুত্ব দেয়। কারণ, একটি দেশ তার প্রতিবেশীর জন্য ভালো হতে পারে, তার সমস্যার কারণও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশে একটি বড় সমস্যা তৈরি করেছে। আবার ভারত থেকে আলু-পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্য সহজেই আমদানি হয়। অনেক বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্যও ভারতে যান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। আমাদের লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ করে এবং ঝুঁকি পর্যালোচনা করে দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক বোঝাপড়া গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি

আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক বোঝাপড়াও কোনও গোপন বিষয় নয়। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভারত অত্যন্ত আরামদায়ক অবস্থানে ছিল। বাংলাদেশে আকস্মিক রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর ভারতের অবস্থান ও মনোভাব পরিবর্তিত হয়েছে।

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিলেন এবং রয়েছেন। শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত সরকার, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ— সবাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে এবং হচ্ছে।

দিল্লিতে শুরু থেকেই বাংলাদেশে ‘হিন্দু কার্ড’ ব্যবহার করা হচ্ছে, যদিও সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়নের ক্ষেত্রে ভারতের রেকর্ড খুব খারাপ। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা হচ্ছে। ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে অপপ্রচারের কারণে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন কমে গেছে।

ভারতের যেকোনও নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসাম এবং বাংলাদেশ সংলগ্ন অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যে ‘বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘হিন্দু কার্ড’ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব বেশিরভাগই হিন্দু ধর্মীয় দলগুলো প্রদর্শন করে। কিন্তু এখন ভারতে কোনও নির্বাচন নেই। এখন বাংলাদেশ বা হিন্দু কার্ড ব্যবহার করার অর্থ হচ্ছে— তারা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ভারতে যারা বিজেপির বিরুদ্ধে, তারাও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছেন।

সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘সারা ভারতে বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি তারা নতুন বাস্তবতা উপলব্ধি করবে এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করবে, তত তাড়াতাড়ি দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।’

তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বাংলাদেশ কেন পরিবর্তনের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটির যৌক্তিকতা ভারত অনুধাবন করছে না।’

ভূ-রাজনীতি

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি কেবল দ্বিপাক্ষিক উপাদানের ওপরেই তৈরি নয়। বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক এবং ভারত ও চীনের সম্পর্কের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্ক। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলমান অস্বস্তিকর সম্পর্ক চীনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।

জটিল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, চীন বর্তমানে দ্বিতীয় সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে এক নম্বর শক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। অপরদিকে, ভারত একটি উদীয়মান রাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে পরিচিত।

সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীনকে লক্ষ্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ক্ষেত্রে ভারত একটি প্রধান অংশীদার। চীন-বিরোধী নীতি অনুসরণে দিল্লি ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এই জটিল সমীকরণের মধ্যেও সব শক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশকে জাতীয় স্বার্থের দিকনির্দেশনা ও অর্জন করতে হবে।’

এখন করণীয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। ডিসেম্বরে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

কূটনীতিকরা বলছেন, বাংলাদেশের কাছে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও বিকল্প নেই। পারস্পরিক মর্যাদার ভিত্তিতে সবার সঙ্গে সুসম্পর্কের নীতির ওপর ঢাকাকে জোর দিতে হবে।

একজন সাবেক কূটনীতিক বলছিলেন, ‘শুধু সরকারি যোগাযোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার পরিবর্তে ট্র্যাক-২ এনগেজমেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মঞ্চে সম্পৃক্ততা বজায় রাখাও প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘এখন যা প্রয়োজন, তা হলো উভয়পক্ষের সংযম এবং নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা। বাংলাদেশ বারবার বলেছে যে, ঢাকা সুসম্পর্ক চায় এবং তা পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতেই হবে এবং এটাই সঠিক বার্তা।’





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত