পূর্ণ নাম ইমাম তাকিউদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে মারুফ আশ-শামি আল-আসাদি। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সিরিয়ার দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন। তার নামের ‘আশ-শামি’ অংশটি নির্দেশ করে যে, তিনি ঐতিহাসিক শাম অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন, যেখানে বর্তমানে সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, জর্ডান ও ইসরায়েলের অঞ্চলগুলো অন্তর্ভুক্ত। তাকিউদ্দিন তার বংশপরিচয়কে আইয়ুবি রাজবংশের সঙ্গে যুক্ত করেছেন এবং নিজেকে রাজকুমার নাসির আল-দীন মানকারুসের বংশধর হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে কিছু গবেষক তাকে শুধু একজন উসমানীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তাকিউদ্দিন প্রাথমিকভাবে ধর্মতত্ত্বের শিক্ষায় মনোযোগী ছিলেন, তবে পরবর্তী সময়ে তিনি যুক্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। দামেস্ক ও কায়রোতে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, প্রকৌশল, আলোকবিজ্ঞান, যান্ত্রিকবিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৫৭১ সালে তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের প্রধান জ্যোতির্বিদ হিসেবে নিয়োগ পান এবং ইস্তাম্বুলে বসবাস শুরু করেন। সুলতান তৃতীয় মুরাদের শাসনামলে তিনি ইস্তাম্বুল মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যা মধ্যযুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানমন্দির হিসেবে বিবেচিত হয়।
তাকিউদ্দিন অটোমান সাম্রাজ্যে একটি উন্নত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক মানমন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তার নির্মিত মানমন্দিরটি ডেনিশ বিজ্ঞানী ট্যুকো ব্রাহের বিখ্যাত উরানিবর্গ মানমন্দিরের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এ মানমন্দিরে তিনি একটি উন্নত যান্ত্রিক ঘড়ি স্থাপন করেন, যা গ্রহ ও তারার গতি নির্ণয়ে সহায়ক ছিল। তিনি ১৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মহাধূমকেতুর পর্যবেক্ষণ করেন এবং তার গবেষণার জন্য যান্ত্রিক ঘড়ি ব্যবহার করেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিকূলতার কারণে ১৫৮০ সালে মানমন্দিরটি ধ্বংস করা হয়।
তাকিউদ্দিন শুধু জ্যোতির্বিদই ছিলেন না, বরং তিনি একজন কৌশলীও ছিলেন। তিনি সালাতের সময় নির্ধারণের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় নির্দেশক যান্ত্রিক ঘড়ি নির্মাণ করেন। এ বিষয়ে তার প্রথম গ্রন্থ ‘আল-কাওয়াকিবুদ দুররিয়া ফি ওয়াদ আল-বাঙ্কামাত আদ-দাওরিইয়া’ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা। তিনি পানি উত্তোলনের জন্য চার প্রকারের যান্ত্রিক পদ্ধতির বর্ণনা দেন এবং তার গ্রন্থ ‘আত-তুরুক আস-সামিয়্যা ফি আল-আলাত আর-রুহানিয়্যা’তে বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহার সংক্রান্ত তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। আলোকবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি ‘নাওর হাদিকাতুল আবসার ওয়া নূর হাকিকাতুল আনজার’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে আলোর গঠন, প্রতিসরণ ও বিকিরণসংক্রান্ত বিশদ আলোচনা রয়েছে। এ ছাড়া তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু রচনা হচ্ছে—‘সিদরাত মুনতাহা আল-আফকার ফি মালাকুত আল-ফালাক আদ-দাওয়ার’, জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যেখানে ত্রিকোণমিতির গণনা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। ‘জারিদাত আদ-দুরার ওয়া খারিদাত আল-ফিকার’, জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যেখানে দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি ও ত্রিকোণমিতির বিভিন্ন অপেক্ষক ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ‘রায়হানাতুর রুহ’, যেখানে তিনি তার পারিবারিক ইতিহাস ও বংশ-পরিচয় উল্লেখ করেছেন। ‘দুস্তুর আত-তারজিহ লি-কাওয়া ঈদ আত-তাসি’, যেখানে তার গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।
তাকিউদ্দিন ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ইস্তাম্বুলে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বহু ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখেছেন এবং মধ্যযুগের মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার গবেষণা পরবর্তী বিজ্ঞানীদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এবং তার উন্নত যান্ত্রিক পদ্ধতিগুলো আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়েছে। তার নির্মিত মানমন্দির, যান্ত্রিক ঘড়ি ও গবেষণাগুলো প্রমাণ করে যে, তিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ।