গত ৯ অক্টোবর ১৩০ জনেরও বেশি ইসরায়েলি রিজার্ভ সেনা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্টের কাছে একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। চিঠিতে তারা গাজা ও লেবাননে আবারও যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করেছেন। সেই সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং গাজায় আটক ১০১ বন্দিদের ফিরিয়ে আনার জন্য চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের পরিষেবা দিতে অস্বীকার করেছেন। এ নিয়ে এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমাদের মধ্যে কিছু লোকের সহ্যের সীমা অনেক আগেই অতিক্রান্ত হয়েছে। অন্যদের জন্যও ক্রমেই এটি দুঃসহ হয়ে উঠছে। ভগ্ন হৃদয় ভেঙে গেছে। সেই দিন দ্রুতই এগিয়ে আসছে যেদিন আমরা কোন ধরনের সেবা দেওয়া বন্ধ করে দিব।’
ইসরায়েলি এই রিজার্ভ সেনাদের একজন ইওতাম ভিল্ক। গত বছর ৭ অক্টোবর হামাস যখন দক্ষিণ ইসরায়েলে আক্রমণ চালায়,তখন রিজার্ভ সেনা ইওতাম ভিল্ককে সামরিক ডিউটিতে ডাকা হয়নি –তিনি স্বেচ্ছায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেই থেকে গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাথে ২৩০ দিনেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন তিনি।
সিএনএনকে টেলিফোন সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সেই ৭ অক্টোবর, আমি দ্বিধা করিনি… কারণ আমার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাদের রক্ষা করার প্রয়োজন আছে।
কিন্তু এই গ্রীষ্মে গাজায় রিজার্ভ ডিউটি শেষ করার পর, তিনি আবারও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করছেন।
তিনি মনে করেন, কিছু ক্ষেত্রে সামরিক পদক্ষেপ ন্যায়সংগত, তবে তা শুধু কূটনৈতিক সমাধানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হওয়া উচিত। কিন্তু তার সরকার এরকম কোনও লক্ষ অর্জনে আগ্রহী বলে মনে করেন না ভিল্ক।
তিনি বলেছেন, গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ আরও তীব্র হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের জীবন এবং ইসরায়েলি বন্দিদের জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।
কারণ ভিল্কের আশঙ্কা, তিনি এমন এক যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন যার ফলস্বরূপ গাজার ওপর আরেকটি ইসরায়েলি দখলদারি শুরু হতে পারে যার অংশ হতে তিনি চান না।
যদিও নেতানিয়াহু বলেছিলেন গাজায় কোনো পুনর্বাসন হবে না। ভিল্ক জানান, অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণে সরকারের সমর্থন তাকে নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্যের বিষয়ে সন্দেহজনক করে তুলেছে। নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভায় এমন কট্টর ডানপন্থি মন্ত্রীরা রয়েছেন যারা গাজায় ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
ভিল্ক বলেন, তারা আমাকে ভয়ানক অবস্থায় ফেলেছে… আমি আমার নিজের সরকারের দ্বারা প্রতারিত বোধ করছি।
তবে তিনি একা নন। আরেক রিজার্ভ সেনা ম্যাক্স ক্রেশ অক্টোবর ৭ এর পর ৬৬ দিন ইসরায়েলের লেবানন সীমান্তে যুদ্ধ করেছেন। তিনিও ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।
ক্রেশ বলছেন, তিনি আর এই যুদ্ধে থাকতে চান না। ডিসেম্বরের শেষে যখন তিনি জেরুজালেমে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন, গভীর বিষন্নতায় পড়ে যান। এখন তিনি মানসিকভাবে বেশ কঠিন সময় পার করেছেন।
তিনি বলেন, আমি যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম তাদের বেশিরভাগই ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে এই যুদ্ধ করছিল। আর এই বিষয়টিকে নিজের জন্য অস্বস্তিকর বলে মন্তব্য করেছেন ক্রেশ।
তিনি বলেন, ‘এক সেনা তাকে বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন গাজায় ফিলিস্তিনিদের এমনকি শিশুদেরও হত্যা করা ইহুদি ধর্মীয়দের কর্তব্য। কারণ ওই শিশুরা বড় হয়ে সন্ত্রাসী হবে!’
ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভিরও একই ধরনের মতামত প্রকাশ করেছেন উল্লেখ করে ক্রেশ আরও বলেন, কিছু সহকর্মীর এমন চরমপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি শোনা ও সহ্য করা তার জন্য খুবই কঠিন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২৮ বছর বয়সী আরেক রিজার্ভ সেনা বলেছেন, আমরা এক বছর পার করেছি এবং আমাদের এখনও একটি জিম্মি চুক্তি হয়নি। তবে তিনি বলেছেন, চুক্তি করার অর্থ-এই নয় যে চুক্তি হওয়ার পর যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যেতে প্রস্তুত আমি।
এই যুদ্ধ চিরকালের যুদ্ধ হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। আর এই যুদ্ধকে তিনি নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক লাভের জন্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন।
তবে ইসরায়েলি রিজার্ভ সেনাদের যুদ্ধ করতে অস্বীকার করার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। গত মে মাসে দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে আক্রমণ চালানোর সময় এ ধরনের চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ৪০ রিজার্ভ সেনা। কিন্তু এবারে এই সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। অবশ্য যারা এ ধরনের চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন তাদের আটক করার আহ্বান জানিয়েছেন ইসরায়েলের পরিবহনমন্ত্রী মিরি রেগেভ।