Homeদেশের গণমাধ্যমেগঙ্গা পানি চুক্তি নবায়ন: ভারত যাচ্ছে বাংলাদেশের দল

গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়ন: ভারত যাচ্ছে বাংলাদেশের দল


বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সেটি নবায়ন নিয়ে আলোচনার জন্য কলকাতা সফরে যাচ্ছে বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল।

সোমবার (৩ মার্চ) কলকাতায় পৌঁছানোর কথা বাংলাদেশের ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দলটির। পাঁচ দিনের সফরে তারা কলকাতায় পানি চুক্তি নবায়ন-সংক্রান্ত বৈঠক করবেন; পরিদর্শন করবেন ফারাক্কা বাঁধ।

ভারতের কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম কমিশনার আর আর সাম্ভারিয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থকে একটি চিঠি লিখে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সফর নিয়ে বিস্তারিত সূচি জানিয়েছেন। একই চিঠিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর গঙ্গা পানি চুক্তি হয়। তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এইচ ডি দেব গৌড়া।

গঙ্গা পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৬ সালে। তার আগেই এই চুক্তি নবায়ন নিয়ে উভয় দেশে আলোচনা রয়েছে। ২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে শেখ হাসিনার ভারত সফরে গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন নিয়ে কথা হয়েছিল।

ভারতে গঙ্গা নামে পরিচিত নদীটিই বাংলাদেশের পদ্মা নদী। হিমালয়ের গাঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশে করে বঙ্গোপসারে মিলিত হয়েছে পদ্মা। ফারাক্কা বাঁধ হওয়ার পর এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা ধীরে ধীরে শুকিয়ে মরুপ্রান্তরে রূপ নিয়েছে।

চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, পাবনা অংশে শুকনো মৌসুমে পদ্মার বুকজুড়ে বিরাট বালুচর জেগে ওঠে। পানি প্রবাহের সংকটে শুধু পদ্মাই বিলীনপ্রায় হয়নি, পদ্মা থেকে উৎপন্ন অনেক ছোট-বড় নদীও শুকিয়ে হয় সরু খাল, না-হয় মরে গেছে। বাংলাদেশ চায় গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা। এবার আলোচনায় বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।


একসময়ের প্রমত্তা পদ্মার বুকে এখন শুকনো মৌসুম ফসলের আবাদ হয়।


আর আর সাম্ভারিয়ার লেখা চিঠি অনুযায়ী, ৬-৭ মার্চ কলকাতায় বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশনের ৮৬তম সভা হবে। তার আগে ৪-৫ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল ও ভারতের কর্মকর্তারা ফারাক্কা বাঁধ পরিদর্শন করবেন।

যৌথ নদী কমিশনের বাংলাদেশের সদস্য মুহম্মদ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধি কলকাতায় ভারতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেবেন।

কলকাতার মুখ্য সচিবকে লেখা আর আর সাম্ভারিয়ার সই করা চিঠিতে সফরসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী, ৩ মার্চ সোমবার বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলটি বিমানে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিট নাগাদ কলকাতায় পৌঁছানোর পর ওই দিনই ট্রেনে করে তারা ফারাক্কা যাবেন। ৪ মার্চ তারা ফারাক্কায় পানি প্রবাহ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করবেন। পর্যবেক্ষণ শেষে ৫ মার্চ কলকাতায় ফিরবেন তারা। ৬ ও ৭ মার্চ কলকাতায় একটি পাঁচতারকা হোটেলে দুই দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠক হবে।

গঙ্গার পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে হলেও এই দীর্ঘসময়ে চুক্তিটির সমালোচনা করে এসেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। তাদের অভিযোগ, গঙ্গা পানি চুক্তিতে শুধু ভারতের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে; ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের।

গঙ্গার পানি চুক্তি নিয়ে বিএনপির অসন্তোষ থাকলেও এবার চুক্তি নবায়নের আলোচনা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার কী ধরনের অবস্থান নেয়, তা নিয়ে কৌতূহল থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা এবং বিএনপিসহ বিভিন্ন দল গঙ্গা থেকে পানি প্রবাহ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে আসছে। ঢাকার এবার দিল্লির কাছে আগের চেয়ে বেশি পানি চাইবে। সেই দাবি ভারত মানবে কিনা, তা নির্ভর করছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ওপর।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে ধুধু বালুচর। 


পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বহুবার বলেছেন, বাংলাদেশকে অতিরিক্ত দেওয়ার মতো পানি গঙ্গায় নেই। গঙ্গার পানি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের চাহিদাই মিটছে না; বাংলাদেশকে আরো পানি কীভাবে দেবেন।

যৌথ নদী কমিশন বাংলাদেশ ও ভারতের ৫৪টি নদী নিয়ে কাজ করে থাকে। গঙ্গা বা পদ্মা তার একটি। গঙ্গা চুক্তি হলেও দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে কথা হচ্ছে। তবে সেই চুক্তি আজো হয়নি। তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে পেতে সম্প্রতি তিস্তা পাড়ে সমাবেশ করে বিএনপি, তাতে যোগ দেয় উত্তরাঞ্চলের মানুষ। এবার বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভারতীয় কর্মকর্তাদের বৈঠকে তিস্তা ইস্যু নিয়ে উত্তাপ ছড়ায় কিনা, তাও দেখার বিষয়।


গঙ্গা পানি চুক্তিতে যা আছে

ভারত ১৯৭৪ সালে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে। এর ফলে বাংলাদেশ গঙ্গা থেকে পানি প্রবাহ কমে যায়, যা দেশের নদী ও কৃষির জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক নদীর ওপর এভাবে একতরফা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদ শুরু হয় বাংলাদেশে। দীর্ঘ আলোচনা ও পর্যালোচনার পর ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা চুক্তি করতে রাজি হয় এবং ১৯৯৬ সালে সেই চুক্তি সম্পন্ন হয়।

সেই চুক্তি অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত দুই দেশ শর্তমতে পানি ভাগাভাগি করে নেবে। চুক্তিতে বলা আছে, নদীতে ৭০ হাজার কিউসেক বা তার কম পানি থাকলে দুই দেশ সমান সমান পানি ভাগ করে নেবে। পানির পরিমাণ ৭০ হাজার কিউসেক থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক হলে ৪০ হাজার কিউসেক পাবে বাংলাদেশ। অবশিষ্ট প্রবাহিত হবে ভারতে। আবার নদীর পানির প্রবাহ ৭৫ হাজার কিউসেক বা তার বেশি হলে ৪০ হাজার কিউসেক পানি পাবে ভারত। অবশিষ্ট পানি প্রবাহিত হবে বাংলাদেশে।

তবে কোন কারণে যদি ফারাক্কা নদীর পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নীচে নেমে যায় তাহলে দুই দেশে কে কী পরিমাণ পানি পাবে সেটা পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে।

ভারতের হুগলী নদীতে পানি সরবরাহ এবং কলকাতা বন্দরটি সচল করার জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা হয়, যার অবস্থান বাংলাদেশ থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে ভারতের ভূখণ্ডে গঙ্গা নদীর ওপরে।

গত চার দশকেরও বেশি সময়ে এই বাঁধ গঙ্গা অববাহিকায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে, যে কারণে কারণে ক্ষতির মুখে পড়ে উভয় দেশ।

ভারতের বিহার ও উত্তরপ্রদেশে প্রতিবছর বন্যা ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রীরা সরকারের কাছে ফারাক্কা বাঁধ সরিয়ে স্থায়ী সমাধান চেয়ে আসছেন। একই দাবি বাংলাদেশের পরিবেশবাদীদেরও। কেননা এই বাঁধের কারণে বর্ষার মৌসুমে বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমের বেশ কিছু জেলাও বন্যা ও নদী ভাঙনের কবলে পড়ে।

বাংলাদেশের পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, যখন পানি দরকার তখন ভারত আটকে রাখে। আর বর্ষার মৌসুমে যখন বন্যার সময়, তখন ফারাক্কার গেট খুলে দেয়। ফলে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রে এই সমস্যার সমাধান করা দরকার। 

তিস্তা নিয়ে সংকট

তিস্তা চুক্তি নিয়েও ঘোর আপত্তি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সম্মত হয়ে কয়েক দফায় তিস্তা চুক্তি করার প্রস্তুতি নিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারে মমতার বাগড়ার কারণে।

তিস্তা পানি চুক্তি করা না গেলেও ২০২৪ সালে সামনে আসে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বা তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের বিষয়টি। চীনের ঋণে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা এগিয়ে গেলেও ভারত তাতে বাগড়া দেয়। শেষমুহূর্তে শেখ হাসিনা সরকারও ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অবশ্য গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর সেই আলোচনা আর এগোয়নি।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত