আধুনিক কর্মজীবনের জটিল গোলকধাঁধায় সাফল্য অর্জনের জন্য দুটি স্তম্ভের ওপর ভর করা অপরিহার্য: কমিউনিকেশন ও ব্যবস্থাপনা। এই গুণাবলি কেবল ব্যক্তিগত পরিসরে নয়, বরং পেশাগত জীবনের প্রতিটি স্তরে আলোকবর্তিকার মতো পথ দেখায়। একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য এবং উন্নতির ভিত্তি রচিত হয় কার্যকর যোগাযোগ এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ে। এই দুটি গুণ একটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সম্পর্কের সুস্থতা নিশ্চিত করে, যা সামগ্রিক কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ, নিছক তথ্য আদান-প্রদান নয়, বরং এটি একটি সেতু যা মানুষে মানুষে সংযোগ স্থাপন করে। এই সংযোগ স্থাপনের প্রক্রিয়ায় শুধু কথা বলা বা লেখা নয়, বরং সঠিকভাবে শোনা, গভীর মনোযোগের সাথে বোঝা এবং যথাযথ প্রতিক্রিয়া জানানোও অন্তর্ভুক্ত। কার্যকর যোগাযোগ ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উভয় ক্ষেত্রেই সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে।
পিটার ড্রাকার বলেছেন, কমিউনিকেশন হলো একটি প্রতিষ্ঠানের জীবন রক্ত (Life Blood)। কমিউনিকেশনের মূল ভিত্তি হলো স্পষ্টতা। বার্তাটি এমনভাবে প্রকাশ করা উচিত, যাতে শ্রোতা সহজেই তা অনুধাবন করতে পারে। জটিল তথ্যকে সহজ, বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপন করা জরুরি, যাতে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে।
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা প্রায় ২৫% কমে যায়। কার্যকর যোগাযোগের জন্য সক্রিয় শ্রবণ অপরিহার্য। অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং বোঝার মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো যায়। শুধু বার্তা প্রেরণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং প্রাপ্ত বার্তার ওপর যথাযথ প্রতিক্রিয়া জানানোও গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিশ্চিত করে যে বার্তাটি সঠিকভাবে বোঝা হয়েছে এবং প্রেরক ও প্রাপকের মধ্যে একটি ফলপ্রসূ কথোপকথন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ কৌশল প্রয়োজন। লিখিত, মৌখিক এবং অ-মৌখিক যোগাযোগ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি, যাতে প্রতিটি পরিস্থিতিতে সঠিক মাধ্যমটি ব্যবহার করা যায়। আধুনিক যুগে ই-মেইল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগ আরও সহজ এবং দ্রুত করা যায়, যা সময় এবং দূরত্বের বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করে। ম্যাককেনজি গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিজিটাল কমিউনিকেশন টুলস ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা ২০-২৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ব্যবস্থাপনা হলো পরিকল্পনা, সংগঠন, পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করার একটি সুসংহত প্রক্রিয়া। এটি একটি দলকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। দক্ষ ব্যবস্থাপনা একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং অপচয় কমায়, যা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা এবং লাভজনকতা বাড়ায়। “ব্যবস্থাপনা হলো লক্ষ্য অর্জনের শিল্প” – মেরি পার্কার ফোলেট। যেকোনো প্রকল্পের শুরুতে সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি। লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সম্পদ এবং কর্মীদের সঠিকভাবে সংগঠিত করা ব্যবস্থাপনার একটি মূল কাজ। এটি নিশ্চিত করে যে কাজগুলো সময়মতো এবং দক্ষতার সাথে সম্পন্ন হয়, যা প্রকল্পের সময়সূচি এবং বাজেট রক্ষা করতে সাহায্য করে। গ্যালাপের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিষ্ঠানের কর্মী অসন্তোষের হার প্রায় ৭০% বৃদ্ধি পায়। একজন ভালো ব্যবস্থাপককে অবশ্যই ভালো নেতা হতে হবে। কর্মীদের অনুপ্রাণিত করা এবং তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করা জরুরি, যাতে তারা নিজেদের সেরাটা দিতে পারে।
কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে সংশোধন করা ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটি নিশ্চিত করে যে লক্ষ্য অর্জনের পথে কোনও বাধা না থাকে এবং প্রকল্প সঠিক পথে পরিচালিত হয়। সময় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা একজন ব্যবস্থাপকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো কাজ সম্পন্ন করা এবং অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা জরুরি, যাতে প্রকল্পের সময়সীমা এবং মান বজায় থাকে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষ সময় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা প্রায় ৩০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব।
কমিউনিকেশন এবং ব্যবস্থাপনা একে অপরের পরিপূরক। কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য ভালো কমিউনিকেশন অপরিহার্য। একজন ব্যবস্থাপককে অবশ্যই কর্মীদের সঙ্গে স্পষ্টভাবে যোগাযোগ করতে হবে, তাদের অনুপ্রাণিত করতে হবে এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। একইভাবে, কার্যকর কমিউনিকেশন একটি দলের মধ্যে সহযোগিতা এবং সমন্বয় বাড়ায়, যা লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক। আধুনিক কর্মজীবনে, যেখানে প্রতিযোগিতা তীব্র, সেখানে কমিউনিকেশন এবং ব্যবস্থাপনার দক্ষতা একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ধারণ করে।
তাই, এই দুটি গুণ অর্জনে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে সাফল্য অর্জনের জন্য এই গুণগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গুণগুলো অর্জনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি কেবল নিজের কর্মজীবনই নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক সাফল্যেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে কমিউনিকেশন এবং ব্যবস্থাপনা দক্ষতা কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন দক্ষতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে। এজন্য এই দক্ষতাগুলো অর্জন করা ভবিষ্যতের কর্মজীবনের জন্য অপরিহার্য।
লেখক : কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস, স্ট্রাটেজিস্ট অ্যান্ড সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।
এইচআর/এমএস