‘আমার ভাই আল আমিন ছোটবেলা থেকেই ধার্মিক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। প্রতি বছর রোজা রাখতো। চাকরি হওয়ার পর হজ করেছে। সৎলোক ছিল। কখনও অন্যায় কাজে জড়ায়নি। যে ব্যক্তি ইসলামের প্রতি এতটা অনুগত সে কোনোদিন আত্মহত্যার মতো পাপ করতে পারে না। আমার ভাই আত্মহত্যা করতে পারে না।’
বুধবার কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল আমিনের বড় বোন সালমা আক্তার। গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে জাজিরা থানা ভবনের দ্বিতীয় তলার নিজ কক্ষ থেকে ওসি আল আমিনের (৪৫) ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। তার এভাবে মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা। সালমা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেভাবে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে আত্মহত্যা করেনি। আর কেনই বা আত্মহত্যা করবে? যারা বলেছে, আত্মহত্যা করেছে তারা আসল কারণটা আমাদের জানাক। তাকে হত্যার পর ঝুলিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়েছে। এজন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, ভাইয়ের মৃত্যুর আসল রহস্য তদন্ত করে বের করার।’
আল আমিনের পরিবার সূত্রে জানা যায়, বরিশালের মুলাদী উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের কাজীরচর গ্রামের মৃত বেলায়েত হোসেন ব্যাপারীর ছেলে আল আমিন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ছিলেন সবার ছোট। তার স্ত্রীর নাম শরিফুন্নেছা। এই দম্পতির রাদিয়া ও রাফিয়া নামে যমজ দুই কন্যা রয়েছে। তারা রাজধানীর ভিকারুন্নেছা নূন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাজিরা থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন। চাকরি হওয়ার পর খুব একটা গ্রামে না এলেও ফোনে আত্মীয়-স্বজন, ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগযোগ করতেন। সবার বিপদে সাহায্য করতেন।
ওই দিন লাশ উদ্ধারের পর শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আল আমিন আত্মহত্যা করেছেন।’
একই দিন শরীয়তপুর পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসক মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘ওসি আল আমিনের গলায় গামছা প্যাঁচানো ছিল। তার শরীরে অন্য কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি গলায় গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।’
বাড়িতে থাকা আল আমিনের মেজো ভাই মধুমতি ব্যাংকের কর্মকর্তা আবুল কালাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর আল আমিনকে শরীয়তপুরের জাজিরা থানায় বদলি করা হয়। এর আগে যে কয়েকটি থানায় দায়িত্ব পালন করেছে কোথাও তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ওঠেনি। ঘুষ ও অনিয়ম এড়িয়ে চলতো। বেতনের বাইরে কোনও অর্থ উপার্জন করেনি। খুব কষ্ট করে সংসার চালাতো। আমরা বুঝতাম তার কষ্ট।’
দুই মেয়েকে ঢাকায় বোনের বাসায় রেখে পড়াশোনা করাতে কষ্ট হতো ভাইয়ের উল্লেখ করে আবুল কালাম বলেন, ‘এ কারণে বারবার ঢাকায় যেতো না। গ্রামের বাড়িতেও খুব একটা আসতো না। ২০২৩ সালে মা মারা যান ও ৪ মাসের মাথায় বড় ভাই আবদুস সালামের মৃত্যু হয়। আল আমিন সববময় নিজের খরচ কমিয়ে তা দিয়ে সংসার চালাতো। ধার্মিক ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। খুবই সাদাসিধে ছিল। এমন মানুষটির সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয়টি কোনোভাবেই যায় না। মৃত্যুর পেছনে কোনও একটি রহস্য তো অবশ্যই রয়েছে।’
বৃহস্পতিবার দুপুরের পর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে জাজিরা থানায় ছুটে যাই উল্লেখ করে আবুল কালাম বলেন, ‘গিয়ে দেখি, আমার ভাইয়ের নিথর দেহ। এভাবে আমার ভাইকে দেখতে হবে, কল্পনাও করিনি। ভাই হারানোর এই কষ্ট-বেদনা কতটা ভারী, তা কীভাবে বোঝাবো। সেখানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাদের মতে আল আমিন আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আল আমিনের চরিত্রের সঙ্গে তা কোনোভাবেই মেলাতে পারছি না। যে কোনোদিন কোনও অনিয়মে জড়ায়নি, আত্মহত্যার মতো পাপ কাজ সে কোনোদিন করতে পারে না। পরে ঢাকা থেকে ফরেনসিক বিভাগের টিম আনা হয়। তারা সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।’
তিনি বলেন, ‘গত শুক্রবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর বাদ আসর শরীয়তপুর পুলিশ লাইনসের মাঠে জানাজা হয়। পরে আমরা লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেছি।’
আল আমিন মানসিক চাপে কিংবা কোনও বিষয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন কিনা তা কারও সঙ্গে শেয়ার করেনি জানিয়ে আবুল কালাম আরও বলেন, ‘এসব বিষয়ে স্ত্রী-সন্তানকেও বলেনি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত আমরা কিছু বলতে চাই না। শুধু এইটুকু বলবো, এটি হত্যাকাণ্ড। লাশ যেভাবে পাওয়া গেছে, আত্মহত্যা করার কোনও নমুনা সেখানে আমি দেখিনি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে আমার অনুরোধ, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে কোনোভাবেই যেন কোনও অদৃশ্য শক্তির হাত না পড়ে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় প্রতিবেদন হলে যদি আত্মহত্যা হয়ে থাকে তাহলে আমরা মেনে নেবো। এজন্য স্বচ্ছ সঠিক একটা প্রতিবেদন হোক।’
আল আমিনের ফুফাতো ভাই মামুন মাতুব্বর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গ্রামে এলে কখনও তার মধ্যে ওসি ভাব দেখা যেতো না। বাড়ি থেকে বের হয়ে সড়কে যাকে পেতো তার সঙ্গেই কথা বলতো। খোঁজখবর নিতো প্রতিবেশীদের। খুবই সাদাসিধে জীবন যাপন করতো।। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থা থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে দেখেছি। কখনও নামাজ বাদ দেয়নি। তার এভাবে মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে ঢাকা থেকে গ্রামে আসে দুই মেয়ে। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা ছিল না আমাদের। আল আমিনের মৃত্যুতে তার পরিবার এবং দুই মেয়ের পড়াশোনা অনিশ্চয়তায় পড়ে গেলো।’
স্বামীর মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ স্ত্রী শরিফুন্নেছা। দুই সন্তানকে নিয়ে এখনও বাকরুদ্ধ অবস্থায় আছেন। এর ফাঁকে কেঁদে কেঁদে বলেছেন, ‘আল আমিন আত্মহত্যা করেনি। তার মুত্যু কীভাবে হয়েছে, সে রহস্য আমি পুলিশের দায়িত্বশীলদের কাছে জানতে চাই। এজন্য সরকার এবং পুলিশ বিভাগের সহায়তা চাই। এর সঠিক তদন্ত হোক। আমার দুই অবুঝ সন্তানের দিকে তাকিয়ে হলেও এই মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন করুক পুলিশ।’
এ ব্যাপারে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ওসি আল আমিনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তার বড় ভাই একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন। এ ছাড়া ঘটনাটি নিবিড়ভাবে তদন্ত করার জন্য জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলে তার মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘অধিকতর তদন্তের জন্য সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে ফরেনসিক বিভাগ। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে আমরা নিশ্চিত হবো, কীভাবে মৃত্যু হয়েছে।’