গোপন বন্দিশালায় টর্চারের চোটে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অনেক কান্নাকাটি করা ছেলেটিকে খুঁজে পেয়েছেন গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস। তাকে খুঁজে পেয়ে তিনি বলেন, ‘এটাই সেই ছেলে যার কান্নার শব্দ এত বন্দির মনে দাগ কেটেছিল।’
বুধবার (১২ মার্চ) রাতে ফেসবুকে করা এক স্ট্যাটাসে ছেলেটিকে খুঁজে পাওয়ার এ গল্প জানান নাবিলা ইদ্রিস।
কালবেলার পাঠকদের উদ্দেশে তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
প্রতিদিন মনে হয় যেন অথৈ সাগরে সাঁতরাচ্ছি- এত কেস, এত বাহিনী, এত মানুষ, অথচ সময় এত কম! তার ওপর কত আলামত যে হারিয়ে গেছে। ১৩-১৪ বছর দূরের কথা, ৭-৮ বছরের পুরোনো কল ডেটাই মেলে না। তবু, কেমন কেমন করে যেন কেস ব্রেক হয়, আর আমরা সফলও হই! আমার সবচেয়ে প্রিয় সাফল্যের গল্পটা একেবারে সাম্প্রতিক।
জীবিত ভিক্টিমদের জবানবন্দিতে প্রায়ই একটা ১৫-১৬ বছরের ছেলের কথা আসত- গোপন বন্দিশালায় টর্চারের চোটে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অনেক কান্নাকাটি করত ছেলেটা। কান্নাকাটি থামাতে তাকে আরও বেশি মারা হত। বেশ কিছু বন্দির কাছ থেকে একই বিবরণ বারবার শোনার পর আমরা ছেলেটাকে খুঁজতে শুরু করি। একটা বাচ্চা ছেলে নির্যাতনে পাগল হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত- কিন্তু সে এখন কোথায়, আদৌও বেঁচে আছে কিনা, ফ্যামিলি জানে কিনা, কিছুই জানি না। এটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল।
প্রথম মাসখানেক কোনো অগ্রগতি হয়নি। হঠাৎ এক বন্দি জানালো গুম সেল থেকে বের হওয়ার কয়েক মাস পর সে ছেলেটাকে এক জেলের ‘পাগলা সেলে’ দেখেছে। কিছু আইডেন্টিফায়াবেল বৈশিষ্ট্যও বর্ণনা করল। অবশেষে একটা লোকেশন এবং টাইমলাইন তো পেলাম। তাই নবউদ্যমে আমরা ‘পাগলা সেল’-এর রেজিস্ট্রি জোগাড় করলাম। কিন্তু সে তো বিরাট তালিকা! এদিকে ছেলেটার নাম জানা নেই, তাই কিছুই মেলানো পসিবল না। ইট ওয়াজ আ ডেড এন্ড।
দিন যায়, আমরাও খুঁজি। এক বন্দি জানালো সে এক সময় ছেলেটার নাম জানত, কিন্তু এখন ভুলে গেছে। আমরা বললাম, মনে পড়লে জানাবেন। কদিন পর ফোন করে ঠিকই জানালো! কিন্তু সেই নাম ‘পাগলা সেল’ রেজিস্ট্রিতে নেই- হয়তো ডাকনাম আর অফিসিয়াল নাম আলাদা? আবারও ডেড এন্ড।
তারপর আরেক বন্দি বললেন, একবার তিনি আর ছেলেটা জেল থেকে একই দিনে কোর্টে গিয়েছিলেন। ডেটটা মনে নাই বিধায় কয়েক বছর আগের দুইটা সম্ভাব্য তারিখ দিলেন। সেদিন তিনি ছেলেটার সঙ্গে লাঞ্চ শেয়ার করেছিলেন, কারণ ওর জন্য কেউ খাবার আনেনি। এই ছোট্ট তথ্য আমাদের সংকল্প আরও দৃঢ় করল। কোর্ট হাজিরার তারিখ নিয়ে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত হল যদিও তখনও আমরা শিউর না ছেলেটার আসল নাম কী। যে কলিগ এই অসম্ভব দায়িত্বটা পেলেন তিনি বললেন, ‘খরের গাদায় সুঁই খুঁজব, কিন্তু খুঁজতে হবে!’
এদিকে রমজান শুরু হলে আমি লিটারেলি দোয়া করলাম কেসটা নিয়ে! একদিন কেন জানি এক বন্দিকে ছেলেটার কথা বললাম- কেন বললাম, নিজেও জানি না। সে একই বন্দিশালায় ছিল না। তবে কারেক্ট টাইমলাইনে একই জেলে ছিল, তাই চান্সটা নিলাম। আর আশ্চর্যজনকভাবে সে ছেলেটাকে চিনলও! এমনকি নামও নিশ্চিত করল।
তারপর হেসে বলল, ‘আমি একবার দূরে সাইকেল ভ্রমণে গিয়েছিলাম…।’ আমি চুপচাপ শুনছি- সাইকেলের গল্প শুনতে বসিনি! ‘হঠাৎ টায়ার পাংচার হলে মেরামতের দোকানে গিয়ে দেখি সেই ছেলে!’ কবে??? ‘গত বছর! ও তখনও মানসিক ভারসাম্যহীন। ওর বাবা সাইকেলের দোকানে কাজ করে, ও সেখানেই থাকে।’ ইউরেকা!
টু কাট আ লং স্টোরি শর্ট- ভদ্রলোক ফিরে গিয়ে ছেলেটাকে খুঁজে বের করে আমাদের কাছে আনলেন। আমরা আইডেন্টিটি কনফার্ম করলাম। এটাই সেই ছেলে, যার কান্নার শব্দ এত বন্দির মনে দাগ কেটেছিল। আমি একেবারেই আবেগপ্রবণ নই। কিন্তু যখন ছেলেটা আর তার বাবার সঙ্গে বসে কথা বলছিলাম, চোখের কোণ ভিজে উঠেছিল।
ক্লাস এইট থেকে সবে নাইনে উঠেছিল, নতুন বই হাতে পাওয়ার আগেই দুই বছর গুম, দুই বছর বিনা অপরাধে জেলে, মানসিক ভারসাম্যহীনতা- এই গল্প আরেক দিন। আজ শুধু সেলিব্রেট করতে চাই, কত মানুষ একসঙ্গে চেষ্টা করলে কেমন অবিশ্বাস্যভাবে একটা রহস্যের সমাধান করা যায়, আলহামদুলিল্লাহ!