কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের ৯ বছর পূর্ণ হলো আজ ২০ মার্চ। কিন্তু দীর্ঘ নয় বছরেও চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। এতে তনুর পরিবারে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাদের দাবি আওয়ামী লীগ সরকার চায়নি তাই এই মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে আকুতি জানিয়েছেন তারা।
সোহাগী জাহান তনু কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা পশ্চিম ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের ইয়ার হোসেনের মেয়ে। তিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ছিলেন।
পারিবারিক সূত্র মতে, ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মরদেহ কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরের কালভার্টের ২০ থেকে ৩০ গজ পশ্চিমে ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ২০১৬ সালের ২১ মার্চ বিকেলে তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এরপর প্রথমে ২০১৬ সালের ২১ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় কোতোয়ালি মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সাইফুল ইসলামকে।
এরপর ২০১৬ সালের ২৫ মার্চ মামলার তদন্ত দেওয়া হয় কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম মনজুর আলমকে। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত সিআইডির কুমিল্লার পুলিশ পরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহীম তদন্ত করেন। চতুর্থবার ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট তদন্ত কর্মকর্তা বদল করে সিআইডির নোয়াখালী ও ফেনী অঞ্চলের তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) জালাল উদ্দিন আহম্মদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তিনি চার বছরেরও অধিক সময় এই মামলার কিনারা করতে পারেননি। পঞ্চমবার ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর হত্যা মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) ঢাকার সদর দপ্তরে স্থানান্তর করা হয়। তখন তনু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক মজিবুর রহমান। এরপর পিবিআই তিনবার কুমিল্লা সেনানিবাসে এসে মামলার বাদী তনুর বাবা ইয়ার হোসেন, মা আনোয়ারা বেগম ও তাদের ছোট ছেলে আনোয়ার হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পিবিআই ২০২০ সালের নভেম্বরের পর বাদীপক্ষের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি বলে দাবি পরিবারটির।
এদিকে গত বছরের (২০২৪) ৩০ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ষষ্ঠবারের মতো বদল হয়। তদন্তে দায়িত্ব দেওয়া হয় পিবিআইয়ের ঢাকার আরেক পরিদর্শক তরিকুল ইসলামকে।
এ বিষয়ে তনুর বাবা ও মামলার বাদী ইয়ার হোসেন বলেন, ৯ বছর বিচারের অপেক্ষায় আছি। এতদিন আওয়ামী লীগ সরকার ছিল। তাই বিচার হয়নি। সরকারই চায়নি এই মামলার বিচার হোক। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কাছে তনু হত্যার ন্যায় বিচার দাবি করছি।
তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, নয় বছর যারা মামলার আয়ু (তদন্ত কর্মকর্তা) ছিলেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। ওরা মামলাটারে নষ্ট করে দিয়েছে। ওদেরও বিচার করতে হবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন এক মামলার তদন্ত করতে কয় বছর লাগে?
কুমিল্লার সংস্কৃতিকর্মী খায়রুল আনাম রায়হান বলেন, এই হত্যাকাণ্ড সারাদেশের মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটেছিল। দীর্ঘ ৯ বছরেও আলোচিত এই মামলার কোনো ক্লু উদঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। ধর্ষণের পর একটি মেয়েকে হত্যা করা হয়। এরপর মরদেহ নিরাপত্তা এলাকায় পাওয়া যায়। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার যারা ধামাচাপা দিচ্ছেন কিংবা চেষ্টা করছেন তাদের উচিত নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করা। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।
মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, আমি ঈদের আগে কুমিল্লায় যাবো। এই মামলার তদন্ত হুট করে করা যায় না। কিছু প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ঘটনাস্থলে যেতে হয়। আমরা কাজ করছি।
জাহিদ পাটোয়ারী/এফএ/জিকেএস