Homeদেশের গণমাধ্যমেইসলামে অর্থ উপার্জন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য

ইসলামে অর্থ উপার্জন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য


ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। মানুষের জীবনের প্রতিটি প্রসঙ্গে আলো ফেলেছে ইসলামের ঐশী বিধান। ইসলামের দৃষ্টিতে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত যেমন ফরজ ইবাদত, তেমনি হালাল উপায়ে সম্পদ উপার্জন করাও আবশ্যক। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হালাল উপার্জন করাও অন্যান্য ফরজের পর একটি ফরজ কাজ।’ (বায়হাকি, শুয়াবুল ইমান: ৮৭৪১)। হালাল গ্রহণ করা আল্লাহতায়ালার হুকুম। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মানুষ! পৃথিবীতে হালাল ও তাইয়্যেব যা রয়েছে, তা থেকে আহার করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা: ১৬৮)। ইবাদত কবুলের জন্য হালাল খাদ্য গ্রহণ অন্যতম শর্ত। অর্থাৎ অসৎ উপায়ে অর্জিত সম্পদ ব্যবহার করে ইবাদত করলে তা কবুল হবে না। হাদিসে এসেছে, হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ১০ দিরহাম দিয়ে কোনো বস্ত্র ক্রয় করে এবং সেই ১০ দিরহামের মধ্যে একটি দিরহামও হারাম হয়, যতক্ষণ সেই বস্ত্র তার পরিধানে থাকবে ততক্ষণ তার নামাজ কবুল হবে না।’ (মুসনাদে আহমদ: ৫৭৩২)।

পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জনে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের গুরুত্বের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা দেখতে পাও নদী-সমুদ্রে নৌকা-জাহাজ পানির বক্ষ দীর্ণ করে চলাচল করছে, যেন তোমরা তার অনুগ্রহ (রিজিক) সন্ধান করতে পারো।’ (সুরা ফাতির, আয়াত: ১২)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘এমন বহু লোক রয়েছে, ব্যবসায় ও কেনাবেচা যাদের আল্লাহর স্মরণ, সালাত কায়েম ও জাকাত আদায় থেকে বিরত রাখতে পারে না।’ (সুরা নুর, আয়াত: ৩৭)। সুরা নুরের এ আয়াতে ইমানদারের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। ইমানদাররা যেমন শুধু মসজিদে বসে থাকতে পারে না, তেমনি তারা আল্লাহর কথা ভুলে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকতে পারে না। এ দুটোর মধ্যে সমন্বয় করাই প্রকৃত ইসলাম। ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘রিজিকের ১০ অংশের ৯ অংশই ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে এবং ১ অংশ গবাদি পশুর কাজে নিহিত।’ (আল জামিউস সাগির, হাদিস: ৩২৮১)। তিনি ব্যবসায়ীদের মর্যাদা তুলে ধরে বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সৎ ব্যবসায়ীরা সিদ্দিক ও শহীদের সঙ্গে উঠবেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২১৩৯)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও ব্যবসা করেছেন। ৪০ বছর বয়সে নবী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করার আগেও তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। মহানবী (সা.) ব্যবসায়ের কাজে বিভিন্ন সময় সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, বাহরাইন, ইথিওপিয়াসহ আরবের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন। কখনো আরবের ব্যবসায়ী কাফেলার সঙ্গী হয়ে, আবার কখনো চাচা আবু তালেবের ব্যবসায়ের কাজের সঙ্গী হিসেবে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি একজন সফল এবং আদর্শ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার সততা, কর্মনিষ্ঠা ও সফলতার কথা দ্রুত মক্কার অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন মক্কায় সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন খাদিজাতুল কোবরা (রা.)। তিনি একসময় তার বিশাল ব্যবসা তদারকি করার জন্য একজন সৎ ও যোগ্য লোকের সন্ধান করছিলেন। তখন মুহাম্মদ (সা.)-এর সুনামের কথা তার কানে এলো। এরপর খাদিজা (রা.) ব্যবসায়ের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন মহানবী (সা.)-এর ওপর। মহানবী (সা.) অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে খাদিজা (রা)-এর ব্যবসা পরিচালনা করেন এবং এতে খাদিজা (রা.) অভাবনীয় সফলতা লাভ করেন।

মহানবী (সা.)-এর আদর্শ সাহাবিরা গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছিলেন। তাই দেখা যায়, সাহাবিদের মধ্যে অনেকেই সুবিজ্ঞ ব্যবসায়ী ও সুদক্ষ কারিগর ছিলেন। আবু বকর (রা.) নিজেই বড় মাপের ব্যবসায়ী ছিলেন। খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পরও তিনি নিয়মিত বাজারে যাতায়াত করতেন। উমর (রা.) ও উসমান (রা.)ও ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন।

মুহাজিরগণের মধ্যে অনেকেই ব্যবসায়ী ছিলেন। আমাদের পূর্বসূরি মহামতি ইমামরাও ব্যবসা করতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম মালেক ইবন আনাস (রহ.), ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.), আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) প্রমুখ। তারা নবীজি (সা.)-এর আদর্শের আলোকে বড় মাপের ব্যবসায়ী হতে পেরেছিলেন। মুহাজির সাহাবিগণের প্রায় সবাই কোনো না কোনো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নবীজি নিজেও যেমন নবুওতপ্রাপ্তির আগে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে দেশ-বিদেশ সফর করেছেন, তেমনি সাহাবায়ে কেরামও ব্যবসার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর নানা প্রান্তে গিয়েছেন। ব্যবসার পাশাপাশি তারা প্রচার করেছেন ইসলামের অমীয় বাণী। ইতিহাসে পাওয়া যায়, ব্যবসার উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কেরাম বাংলাদেশে আগমন করেন এবং তাদের মাধ্যমে ইসলামেরও আগমন ঘটে আমাদের এ অঞ্চলে।

ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও দিয়েছে ইবাদতের মর্যাদা এবং ইবাদতের মতোই সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান। ব্যবসায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থরক্ষা করে ইসলাম। ব্যবসার ক্ষেত্রে সততা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ক্রেতাকে ঠকানো, ত্রুটিপূর্ণ পণ্য সরবরাহ করা, অধিক মূল্য নির্ধারণ করা, গুদামজাত করে মূল্যবৃদ্ধি করা, প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষককে তার উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করতে বাধা দেওয়া এগুলো ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করো তা বৈধ।’ (সুরা নিসা: ২৯)। এই আয়াতে বলা হয়েছে, পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। কিন্তু মানুষকে জিম্মি করে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করায় ক্রেতার সম্মতি থাকে না। তবুও ক্রেতা প্রয়োজন পূরণের জন্য কিনতে বাধ্য থাকে। তাই এমন ব্যবসা বৈধ হতে পারে না। অনুরূপভাবে ত্রুটিপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রেও ক্রেতার সম্মতি থাকে না। বিক্রেতার দায়িত্ব ক্রেতাকে প্রথমে ত্রুটির ব্যাপারে জানিয়ে দেওয়া। ত্রুটি গোপন করে ক্রেতাকে প্রতারিত করা ব্যবসা বৈধ নয়। যেসব ব্যবসায়ী ওজনে কম দিয়ে ভোক্তাকে ঠকায় তাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘যারা মাপে কম করে, তাদের জন্য দুর্ভোগ। যারা লোকদের থেকে যখন মেপে নেয় তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদের মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়।’ (সুরা মুতাফ্ফিফিন: ১-৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম করো আর ওজনে কম দিও না।’ (সুরা আর রহমান: ৯)।

ক্রেতাকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীরা নানা ফন্দির আশ্রয় নেয়। ভালোমন্দ মিশ্রণ করে। ওপরে ভালো পণ্য প্রদর্শন করে ভেতরে ত্রুটিপূর্ণ পণ্য রেখে দেয়। এভাবে ক্রেতাকে ঠকানো ও প্রতারিত করা ইসলামে মারাত্মক গুনাহ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একবার নবীজি (সা.) একটি খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি তার হাতকে স্তূপের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। এতে তার আঙুলগুলো ভিজে গেল। তিনি বললেন, হে স্তূপের মালিক! এ কী ব্যাপার? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টির পানি লেগেছে। তিনি বললেন, সেগুলো তুমি স্তূপের ওপরে রাখলে না কেন? তাহলে লোকেরা দেখে নিতে পারত। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজি করে আমার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।’ (মুসলিম: ১০২)।

অনেক ব্যবসায়ী অতি মুনাফার লোভে ভোক্তা বা ক্রেতার অধিকারের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না। ‘বিক্রিত পণ্য ফেরত নেওয়া হয় না’ বা ‘বিক্রিত পণ্য পরিবর্তন করা যাবে না’ এমন লেখা দোকানে ঝুলিয়ে রাখে। পরবর্তীকালে ত্রুটি পাওয়া গেলেও তারা গ্রাহক থেকে পণ্য ফেরত নেয় না। এটা পরিষ্কার জুলুম। ইসলামের বিধানমতে, পণ্য কেনার পর যদি এমন ত্রুটি পাওয়া যায়, যে ত্রুটির কারণে মূল্য তারতম্য হয়ে যায়, তাহলে সেই পণ্য ফেরত দেওয়ার এখতিয়ার আছে ক্রেতার। সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ফতোয়া বোর্ড ‘আল লাজনাতুত দায়িমা লিল ইফতা ওয়াল বুহুস’ তাদের ১৩৭৮৮ নম্বর ফতোয়ায় উল্লেখ করেছে—‘পণ্য ফেরত দেওয়া যাবে না, পরিবর্তন করা যাবে না এরূপ শর্তে ক্রয়-বিক্রয় করা জায়েজ নেই। কারণ এমন শর্তারোপ বৈধ নয়। তাতে ক্রেতার ক্ষতি ও পণ্যের দোষ গোপন করা হয়। তা ছাড়া এর উদ্দেশ্য হলো দোষযুক্ত পণ্যই ক্রেতার জন্য অনিবার্য করে দেওয়া।’

ব্যবসায় সততা রক্ষার বিশেষ পুরস্কার আছে। যারা সৎপথে ব্যবসা করেন, তারা দুনিয়া-আখেরাতে প্রভূত কল্যাণ ও বরকত লাভ করেন। সৎ ব্যবসায়ী পরকালে নবী ও সিদ্দিকগণের সঙ্গে থাকবেন। হজরত আবু সাঈদ (রা.) নবীজি থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী নবীগণ, সিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি: ১২০৯)। একইভাবে ব্যবসায় অসততার জন্য রয়েছে শাস্তি। ব্যবসায় মানুষকে প্রতারিত করা মারাত্মক গুনাহ। হজরত আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির সঙ্গে আল্লাহ কেয়ামতের দিন কথা বলবেন না। তাদের প্রতি তাকাবেন না। তাদের পবিত্র করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি এটা তিনবার পাঠ করলেন।’ আবু জর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা হলো যে ব্যক্তি টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরে। যে ব্যক্তি দান করে খোটা দেয়। যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে।’ (মুসলিম: ১০৬)।

মহান আল্লাহ সবাইকে বৈধ উপার্জনের মাধ্যমে সচ্ছল ও স্বনির্ভর জীবন গড়ার তওফিক দিন।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত