Homeদেশের গণমাধ্যমেআন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলোর কী হবে?

আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলোর কী হবে?


বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ওই সময়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য ও মুর‌্যাল ভাঙচুর করে। বাদ পড়েনি মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যও। আজ ১৬ ডিসম্বর পালিত হচ্ছে ৫৩তম বিজয় দিবস। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত সেসব ভাস্কর্য ও ম্যুরাল তেমনই পড়ে আছে। কবে নাগাদ সেগুলো মেরামত করা হবে বা আদৌ হবে কিনা, তা কেউই বলতে পারছেন না।

জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন এসব ভাস্কর্য সংস্কার বা মেরামতের জন্য বিভিন্ন দফতরে চিঠি পাঠিয়েছে। কিন্তু এখনও সেই চিঠির কোনও সুরাহা হয়নি।

তথ্য বলছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় দেড় হাজার ভাস্কর্য, রিলিফ ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও কিছু কিছু উপড়েও ফেলা হয়। এসব ভাস্কর্য ও ম্যুরালের বেশিরভাগই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। শুধু তাই নয়, ওই সব ভাস্কর্য ও ম্যুরালের সঙ্গে ধ্বংস করা হয়েছে ময়মনসিংহের শশীলজের ভেনাসের মূর্তি, সুপ্রিম কোর্টের থেমিস ও শিশু একাডেমির দুরন্ত ভাস্কর্যটিও। বাদ যায়নি বিভিন্ন জেলায় বীরশ্রেষ্ঠদের স্মরণে নির্মিত জাদুঘর, স্মৃতিস্তম্ভসহ উত্তরবঙ্গ জাদুঘরটিও। সুপ্রিম কোর্টের বার লাইব্রেরির প্রাঙ্গণে অবস্থিত ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে তৈরি ভাস্কর্যটি গত ৭ আগস্ট উপড়ে ফেলা হয়।

বাঙালি জাতির গৌরবগাথা মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত জায়গা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ নির্মাণ শেষে ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। মোঘল শাসনামল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের বিজয় দিবস পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রাম-ইতিহাসের সচিত্র বর্ণনা লিপিবদ্ধ ছিল এই জাদুঘরে। আরও ছিল মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক কিছু স্মারক স্মৃতিচিহ্ন। এসব এখন ধ্বংসস্তূপ। সরেজমিনে দেখা গেছে, গ্যালারির ভেতরে থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রায় সব স্মারক এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা ঘটনার ঐতিহাসিক ছবি ও দলিল ভেঙে ও ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর হামলা করা হয় মেহেরপুরে মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভাস্কর্যে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আম্রকাননের নাম রাখেন ‘মুজিবনগর’। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীও ঘোষণা করা হয় মুজিবনগরকে। ১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল সেখানে ‘মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স’ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে তৎকালীন সরকার। ৬৬ একর জায়গাজুড়ে এই কমপ্লেক্সকে গত ৫ দশকে পরিণত করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের এক টুকরা প্রতিচ্ছবি হিসেবে। ওই কমপ্লেক্সটি এখন ধ্বংসের চিহ্ন বহন করছে।

মেহেরপুরের স্খানীয় মানুষরা জানিয়েছেন, মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভাস্কর্যকে একক ভাস্কর্য হিসেবে ধরা হলেও সেখানে পাঁচ শতাধিক পৃথক ভাস্কর্য ছিল। এখানকার অন্তত ৩০৩টি ছোটবড় ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে।

রাজধানীর অদূরে হেমায়েতপুরে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের একটি ভাস্কর্যও ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে।

মাদারীপুরে নির্মাণাধীন মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিকেন্দ্রের নাম ছিল ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’। শহরের প্রাণকেন্দ্র শকুনির লেকপাড়ে অবস্থিত এই স্মারকের ভেতরের সবকিছু নষ্ট করা হয়েছে।

পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপপেজেলার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বিষয়টি খুবই লজ্জার। দেশপ্রেমিক কোনও সচেতন সুস্থ মানুষ এ কাজগুলো করতে পারে না। যারা এ কাজ করেছে তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। বিচার করা প্রয়োজন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্যই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেবেন। 

পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ দাদাভাই জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার কী সম্পর্ক রয়েছে— তা আমার বোধগম্য নয়। অথচ বিক্ষুব্ধরা সেটাই করেছে। নিসন্দেহে বলা যায়, যারা এসব ভাস্কর্য ভেঙেছে তারা স্বাধীনতাকে ভয় পায়। মুক্তিযুদ্ধকে ভয় পায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ভয় পায়। আমি আশা করছি, অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়গুলো সঠিক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। একইসঙ্গে এসব ভাস্কর্য সংস্কার ও মেরামত করবে।

নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের একজন চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, ভেঙে ফেলা ভাস্কর্য ও ম্যুরাল বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের স্বার্থেই সংস্কার ও পুনঃস্থাপনে বিবেচনা করা যেতে পারে। এর জন্য অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। আশা করছি, বর্তমান সরকার সেটা বরাদ্দ দেবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ভাস্কর্য ও স্থাপনা সংস্কারের কোনও অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। এসব সংস্কারে কোনও অর্থ বরাদ্দ করা হবে কিনা, তাও জানা নেই তাদের। দেশের ৫৩তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে এসব জাদুঘর এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বয়ে বেড়াচ্ছে ক্ষতচিহ্ন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বা স্থানীয় সরকার প্রশাসন থেকে এসব জাদুঘর ও স্থাপনা সংস্কারের এখনও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সমগ্র জাতিকে সঙ্গে নিয়ে সাভার স্মৃতিসৌধে পুষ্পবক অর্পণের মধ্য দিয়ে দেশের সূর্যসন্তানদের শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা। আমরা সেই শুভক্ষণের প্রহর গুনছি।’

উপদেষ্টা বলেন, `মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতিগ্রস্ত ভাস্কর্য ও ম্যুরালগুলো সংস্কার বা মেরামতের কোনও উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি। বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে। আমরা যখনই এসব ভাস্কর্য ও ম্যুরাল মেরামত বা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেবো বা কোনও প্রকল্প গ্রহণ করবো— তখন আপনাদের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে জানিয়েই তা করবো।’ কবে নাগাদ তা চূড়ান্ত হবে, তা এই এখনই বলতে পারছেন না বলেও জানান উপদেষ্টা।  





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত