কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে পুলিশের পিটুনিতে ইয়াসিন মিয়া (৪০) নামের এক অটোরিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে—এমন অভিযোগ এনে থানার ওসি, তিন এসআই ও এক কনস্টেবলসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত রবিবার (১৯ জানুয়ারি) কিশোরগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করেন মারা যাওয়া ইয়াসিন মিয়ার মেয়ে মরিয়ম আক্তার।
মামলাটি গত রবিবার হলেও বাদীপক্ষের আইনজীবী আবু তাহের হারুন বুধবার (২২ জানুয়ারি) সকালে এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা হলেন কটিয়াদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তরিকুল ইসলাম, উপপরিদর্শক (এসআই) কামাল হোসেন, মস্তফা মিয়া, নাহিদ হাসান ও কনস্টেবল আশরাফুল ইসলাম।
এর আগে, এ ঘটনায় ওসি ছাড়া বাকি চার জনকে প্রত্যাহার করে কিশোরগঞ্জ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে ইয়াসিনের মৃত্যুর কারণ জানতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হোসেনপুর সার্কেল) মো. তোফাজ্জল হোসেনকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করেন পুলিশ সুপার (এসপি) মো. হাছান চৌধুরী। আদালত মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার আরজিতে বাদীপক্ষ উল্লেখ করেন, আমার বাবা ইয়াসিন মিয়া পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। সাত থেকে আট বছর ধরে কটিয়াদী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা সড়কে অটোরিকশা চালান। গত ৬ জানুয়ারি বিকালে আমি ও আমার বোন কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান করছিলাম। পরে বাবার অটোরিকশায় করে বাড়ি যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে বাবা আমাদের বসিয়ে রেখে পাওনা টাকা পেতে কটিয়াদীর জালালপুর ইউনিয়নের চরঝাকালিয়া গ্রামের বাসিন্দা লিটন মিয়ার বাড়িতে যান। পুলিশ তখন লিটনকে গ্রেফতার করতে তার বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখানে আমার বাবাকে পেয়ে আসামি মনে করে মারধর শুরু করে। আমার বাবা দৌড়ে অটোরিকশার কাছে চলে আসেন। পুলিশও বাবার পিছু নেয়। পরে আমার বাবাকে ধরে আমাদের সামনে মারধর শুরু করে। বাবাকে বাঁচাতে পুলিশের হাতেপায়ে ধরেও রক্ষা করতে পারিনি। একপর্যায়ে ১ নম্বর আসামি এসআই কামাল হোসেন পায়ের বুট দিয়ে বাবার গলায় চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।
মামলার বাদী মরিয়ম আক্তার অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাবাকে আমাদের দুই বোনের সামনে নির্যাতন করে হত্যা করেছে পুলিশ। কিন্তু আমরা এতদিন পেরিয়ে গেলেও মামলা করতে পারিনি। বিভিন্ন মানুষ নানাভাবে আমাদের ভয়ভীতি দেখানোর কারণে মামলা করতে একটু সময় নিতে হয়েছে।’
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হোসেনপুর সার্কেল) মো. তোফাজ্জল হোসেনের বলেন, ‘মামলা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই। কারণ, এখন পর্যন্ত মামলার কোনও কাগজপত্র আমি হাতে পাইনি।’
তবে অভিযুক্ত ওসি তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখনও মামলা হয়নি। আদালতে অভিযোগ হয়েছে। আদালত অভিযোগটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন।’
কিন্তু এ ব্যাপারে বাদীপক্ষের আইনজীবী আবু তাহের হারুন বলেন, ‘আদালত অভিযোগটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করে মামলার নম্বর যুক্ত করেছেন।’
তবে পুলিশের দাবি, দৌড়ানোর সময় ইয়াসিন অসুস্থ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তখন তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার সময় তার মৃত্যু হয়।
এদিকে ওই এলাকার স্থানীয় লোকজন বলছেন, কটিয়াদীর জালালপুর ইউনিয়নের চরঝাকালিয়া গ্রামের বাসিন্দা লিটন মিয়ার বাড়িতে ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে। লিটন মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। মূলত লিটনকে ধরতে ওই দিন পুলিশ অভিযান পরিচালনা করেছিল। অভিযানে নেতৃত্ব দেন প্রত্যাহার হওয়া এসআই কামাল হোসেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে লিটনের বাড়ির লোকজন দৌড়ে পালিয়ে যান। অভিযানের সময় লিটনের বাড়িতে ইয়াসিনও ছিলেন। ইয়াসিনের বাড়ি নরসিংদী। শুরু থেকেই পরিবারের সদস্যরা পুলিশের নির্যাতনে ইয়াসিনের মৃত্যুর অভিযোগ করে আসছিলেন। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি তার পরিবারের লোকজন বিভিন্ন ভয়ে এতদিন মামলা করতে পারেননি।