Homeজাতীয়৫ আগস্টের আগে-পরে সংখ্যালঘু ও পাহাড়িরা সহিংস হামলার শিকার হয়েছে: জাতিসংঘের প্রতিবেদন

৫ আগস্টের আগে-পরে সংখ্যালঘু ও পাহাড়িরা সহিংস হামলার শিকার হয়েছে: জাতিসংঘের প্রতিবেদন


শেখ হাসিনার পতনের আগে ও পরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে হিন্দু, আহমদিয়া মুসলিম এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক হামলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে; বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, খুলনা, সিলেট ও রংপুরে হামলার ঘটনা বেশি ঘটেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের আমন্ত্রণে স্বাধীনভাবে তদন্ত পরিচালনার পর এক প্রতিবেদনে এমনটি জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর)।

ওএইচসিএইচআর ৩৪টি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এসব হামলার বিস্তারিত সংগ্রহ করেছে, যেখানে ১২ জন সরাসরি ভুক্তভোগী ছিলেন। বেশ কয়েকটি ঘটনায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ‘বিজয় মিছিলের’ অংশ হিসেবে সংঘটিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, ৫ থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ৩৭টি সহিংস ঘটনার তথ্য বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) সরবরাহ করেছে। পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সময়ে ১ হাজার ৭৬৯টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, যেগুলোর মধ্যে ১ হাজার ২৩৪টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ২০টি সাম্প্রদায়িক এবং ১৬১টি অভিযোগ ভুয়া ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে বাঙালি সেটলারদের সঙ্গে ভূমি বিরোধ ও সামরিক হস্তক্ষেপ দীর্ঘদিনের সমস্যা। ৫ আগস্টের পর স্থানীয় পাহাড়ি জনগণের বিরুদ্ধে আক্রমণ বেড়ে যায়। কয়েকটি ঘটনায় স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের নেতাদের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়।

সাবেক সরকারের পতনের পর দেশব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ের ওপর ব্যাপক হামলা চালানো হয়। বিশেষত ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুরসহ উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চলে এ ধরনের সহিংসতা বেশি ঘটেছে। এ ছাড়া সিলেট, খুলনা, রংপুরসহ অন্যান্য এলাকায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলা মূলত সেই সব এলাকায় সংঘটিত হয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে হিন্দুদের দেখা হতো।

হিন্দু ব্যবসায়ী ও গৃহস্বামীরা ওএইচসিএইচআরকে জানিয়েছেন, তাঁদের ব্যবসা, বাড়িঘর, জমি ও ধর্মীয় স্থানে হামলা হয়েছে। তাঁদের দোকান লুটপাট করা হয়েছে, সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে, অগ্নিসংযোগ ও নানা হুমকি দেওয়া হয়েছে। পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ার ফলে এই সহিংসতা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়।

উদাহরণস্বরূপ, এক সাক্ষাৎকারদাতা জানান, ঠাকুরগাঁওয়ে হিন্দু শ্মশান ও মন্দির ভাঙচুর করা হয়। অন্য সাক্ষীরা জানিয়েছেন, হামলার পর ৩-৪ হাজার হিন্দু বাসিন্দা নিরাপত্তার জন্য ভারতীয় সীমান্তের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাঁদের প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। আক্রান্ত পরিবারগুলো নিরাপত্তাহীনতা এবং বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। অনেকে তাঁদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, গবাদিপশু ও ব্যবসা হারিয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এসব হামলা মূলত বিজয় মিছিলের অংশ হিসেবে সংঘটিত হয়, যেখানে সাবেক সরকারের পতন উদ্‌যাপন করা হচ্ছিল। যদিও হামলাকারীদের পরিচয় সব ক্ষেত্রে স্পষ্ট নয়, কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা স্থানীয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য সংগঠনের সমর্থক ছিল। তবে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য সংগঠনের কিছু নেতা এসব সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে এবং ৬ আগস্টের পর তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনালয় রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছে।

বেশ কয়েকটি অভিযোগ এসেছে, হিন্দু প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এক ঘটনায় ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, হামলাকারীদের মধ্যে স্থানীয় বিএনপি নেতারাও ছিলেন।

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তথ্য অনুসারে, ৫ থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে সংখ্যালঘুদের ওপর ৩৭টি সহিংস হামলা সংঘটিত হয়েছে। এসব হামলা যশোর, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, নাটোর, দিনাজপুর, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, মেহেরপুর, বরগুনা, বরিশাল, রাজবাড়ী, ঠাকুরগাঁও, ফরিদপুর, পিরোজপুর ও নেত্রকোনায় ঘটেছে। অধিকাংশ হামলায় বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংস করা হয়েছে। চারটি ঘটনায় মন্দির লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, যার মধ্যে একজন নারীর গলা কাটা হয়েছে এবং একজন পুরুষ ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছেন। এ ঘটনাগুলোর মধ্যে পাঁচটি হামলায় বিএনপি-সমর্থকদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়

৫ থেকে ৯ আগস্টের মধ্যে আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায় সাতটি সহিংসতার শিকার হয়েছে। ওএইচসিএইচআর বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পেয়েছে যে ৫ আগস্ট পঞ্চগড় জেলায় ধর্মীয় নেতাদের নেতৃত্বে একটি দল আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কয়েকজন সদস্যের ওপর হামলা চালায় এবং ১১৭টি বাড়ি ও একটি মসজিদ ধ্বংস করে। ওএইচসিএইচআর আরও একটি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, যেখানে ৫ আগস্টের ওই হামলায় ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর মারাত্মকভাবে আহত হয়। হামলার পর তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত মারা যায়। ওএইচসিএইচআর এখন পর্যন্ত এসব ঘটনায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার তথ্য পায়নি।

চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে নির্যাতন

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাগুলো চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে বিবেচনা করে। তবে বাংলাদেশ সরকার ‘আদিবাসী’ শব্দটি প্রত্যাখ্যান করে এবং সংবিধানের তাঁদের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯৭ সালে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তা কখনো সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি এবং সেনা উপস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত অব্যাহত রয়েছে।

এর মধ্যে জুলাইয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারণার মাধ্যমে এটি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এসব প্রচারণার মধ্যে একটি মিথ্যা দাবি ছিল যে একজন বাঙালি শিক্ষার্থীকে একজন আদিবাসী শিক্ষার্থীর চেয়ে কম সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যদিও প্রকৃতপক্ষে উভয়ই ভর্তি হয়েছিল। এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে উসকে দেয় এবং পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাত্রা বাড়ায়।

৫ আগস্টের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে বিক্ষোভের সময় এবং তার পরেও স্থানীয় ইস্যু, বিশেষ করে সেনা প্রত্যাহারের দাবিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন ও দেয়াললিখন দেখা যায়। আন্দোলন থামাতে সেনাবাহিনী এসব দেয়াললিখন মুছে ফেলে এবং অ্যাকটিভিস্টদের আটক করে। এসব পদক্ষেপ আরও বেশি কঠোর দমন-পীড়নের আশঙ্কা তৈরি করে।

সাক্ষীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ৫ আগস্ট বান্দরবানে সহিংসতা তীব্র হয়ে ওঠে, যেখানে আদিবাসী ও বাঙালি সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিক্ষোভে অংশ নেয়। কিছু সশস্ত্র বাঙালি গোষ্ঠী ট্রাকে করে এসে স্থানীয় এক নেতার বাসভবনে হামলা চালায়।

৫ থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে গণমাধ্যম ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী হিন্দু, আহমদিয়া, বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের উপাসনালয়গুলোর ওপর বিভিন্ন অঞ্চলে হামলার ঘটনা ঘটে। ওএইচসিএইচআরে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধার বুরাশারদুবি গ্রামে তিনটি মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রায় ২০টি বাড়ি লুটপাট করা হয়, যা সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার ইঙ্গিত।

এ ছাড়া মেহেরপুরে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেসের (ইসকন) একটি মন্দিরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ৭ আগস্ট নন্দীপাড়ায় একটি কালীমন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। তবে তদন্তে জানা যায়, এটি ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে নয়, বরং জমির মালিকানা নিয়ে স্থানীয় বিরোধের কারণে ছিল।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত