Homeজাতীয়১২ স্তরের কেক লাপিস, যা তৈরি করতে লাগে ৮ ঘণ্টা!

১২ স্তরের কেক লাপিস, যা তৈরি করতে লাগে ৮ ঘণ্টা!


কেক এক ধরনের শিল্পকর্ম, যেখানে বিভিন্ন রঙ ও স্বাদ একত্রিত হয়ে সৃষ্টি করে নরম ও সুস্বাদু একটি বিস্ময়। আর কেক লাপিস (Kek Lapis) সেই বিস্ময়কে আরও অনন্য করে তোলে, কারণ এর প্রতিটি স্তরে লুকিয়ে থাকে জ্যামিতিক নকশার এক অপূর্ব সমাহার।

কুয়ালালামপুরের উপকণ্ঠে শরিফাহ জাইনন (সংক্ষেপে সেরি)-এর ছোট বেকিং স্টুডিওতে প্রবেশ করতেই নাকে এসে লাগে মাখনের ঘন সুগন্ধ। মালয়েশিয়ায় তখন চলছে রমজান মাস, আর সামনে ঈদুল ফিতর বা ‘হারি রায়া’ উদযাপনের প্রস্তুতি। এই উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ কেক লাপিস, যা একদিকে যেমন চোখধাঁধানো, অন্যদিকে তেমনি সুস্বাদু।

একজন প্রকৌশলী থেকে কেক লাপিস নির্মাতা

প্রকৌশলী হিসেবে একসময় কাজ করলেও, এখন দক্ষ বেকার হিসেবে পরিচিত সেরি তার বেকিং দক্ষতাকে যেন এক বিজ্ঞান পরীক্ষার স্তরে উন্নীত করেছেন। অত্যন্ত নিখুঁতভাবে প্রতিটি স্তর তৈরি করা ও নিপুণ হাতে ব্যাটার ছড়িয়ে দেওয়া দেখে মনে হয়, এটি যেন কোনো গবেষণাগারের পরীক্ষা চলছে।

তার মতো করেই আরেকজন প্রকৌশলী, ক্যারেন চাই, কেক লাপিস তৈরির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছেন। ফ্রান্সের লে কর্ডন ব্লু থেকে পেস্ট্রি আর্ট শেখার পর দেশে ফিরে তিনি তার মায়ের রেসিপিকে আধুনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। চাই বললেন, “বেকিংয়ের বিজ্ঞান বুঝতে পারাটা কেক লাপিস তৈরির ক্ষেত্রে সত্যিই অনেক কাজে দেয়।”

ইন্দোনেশিয়া থেকে মালয়েশিয়ায় কেক লাপিসের আগমন

কেক লাপিসের ইতিহাস শুরু হয় ইন্দোনেশিয়ায়। ডাচ উপনিবেশিকরা ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ‘স্পিট কেক’ নামে পরিচিত ইউরোপীয় স্তরযুক্ত কেক ইন্দোনেশিয়ায় নিয়ে আসে। ইন্দোনেশীয়রা এতে স্থানীয় মশলা—দারুচিনি, লবঙ্গ, জায়ফল—যোগ করে এটি নতুন রূপ দেয়, যা পরে পরিচিত হয় ‘লাপিস লেজিট’ বা ‘হাজার স্তরের কেক’ নামে।

এরপর ১৯৭০-এর দশকে কেকটি মালয়েশিয়ার সারাওয়াকে আসে, যেখানে স্থানীয় বেকাররা এটিকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান। বাহ্যিকভাবে সাধারণ দেখতে হলেও, ভেতরে কাটা মাত্রই দেখা মেলে জটিল ও চমৎকার জ্যামিতিক নকশার, যা কেক লাপিসকে অন্য যেকোনো কেকের চেয়ে আলাদা করে তোলে।

একটি কেক তৈরি করতে লাগে ৮ ঘণ্টা!

সারাওয়াক কেক লাপিস সাধারণত কমপক্ষে ১২ স্তরের হয়। প্রতিটি স্তর ধীরে ধীরে তৈরি করতে হয়, ওভেনে গ্রিল করে প্রতিটি স্তর সঠিকভাবে রান্না করা হয়, যাতে নিচের স্তর কখনো পুড়ে না যায়। কিছু ডিজাইন ২০ বা তার বেশি স্তরের হতে পারে, এবং একটি কেক তৈরি করতে প্রায় ৮ ঘণ্টা সময় লেগে যায়।

জটিল নকশার কেক তৈরি করতে হলে আগে কাগজে ডিজাইন এঁকে নিতে হয়, যাতে প্রতিটি স্তরের রঙ ও আকৃতি নির্ধারিত থাকে। অনেক সময় একাধিক কেক বানিয়ে পরে সেগুলো একসঙ্গে জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়। এর জন্য ঘন জ্যাম বা কনডেন্সড মিল্ক ব্যবহার করা হয় আঠার মতো।

চাই বললেন, “এই কেক তৈরির সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো, বেশিরভাগ ভুল বোঝা যায় একেবারে শেষ ধাপে এসে। ফলে যদি কোনো ভুল হয়, তাহলে পুরো পরিশ্রমটাই বৃথা যায়।”

একটি ভুল থেকেই নতুন ডিজাইন!

চাই তার মায়ের তৈরি করা এক বিশেষ ১৬-পিস ডিজাইনের গল্প শোনালেন, যা এক ভুল থেকেই জন্ম নিয়েছিল। “তিনি ভুল করে কয়েকটি বাড়তি স্তর তৈরি করেছিলেন, কিন্তু সেগুলো ফেলে দিতে চাননি। তাই তিনি সেগুলো নতুন করে কেটে নতুনভাবে সাজান, এবং এভাবেই নতুন ডিজাইন তৈরি হয়। এটি আপনি অন্য কোনো বেকারের কাছ থেকে পাবেন না।”

ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণ

কেক লাপিসের প্রচলিত স্বাদগুলোর মধ্যে রয়েছে চকলেট, ভ্যানিলা, স্ট্রবেরি, রেড ভেলভেট ও সুগন্ধি পাতা পান্ডান। এমনকি হরলিক্স ও মিলোর মতো জনপ্রিয় পানীয়র স্বাদও যুক্ত করা হয়। আধুনিক বেকাররা কেকটিকে আরও আকর্ষণীয় করতে বিভিন্ন স্বাদ ও উপকরণের সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন।

চাই গ্লুটেন-ফ্রি কেক লাপিস তৈরি করেছেন, যেখানে তিনি নারকেল আটা ও পিনাট বাটার ব্যবহার করেছেন। আরেকটি সংস্করণে তিনি ব্যবহার করেছেন ডুমুর, অ্যাপ্রিকট ও দারুচিনি।

দাম বেশি, কিন্তু জনপ্রিয়তা তুঙ্গে

উচ্চমানের উপকরণ ও দীর্ঘ প্রস্তুতি প্রক্রিয়ার কারণে কেক লাপিসের দাম তুলনামূলক বেশি। এক কেজির একটি কেকের দাম ৩০০ রিঙ্গিত (প্রায় ৬,০০০ টাকা) পর্যন্ত হতে পারে। তবে এর চাহিদা সবসময়ই তুঙ্গে, ব্যক্তিগত অর্ডার ছাড়াও এটি কর্পোরেট গিফট ও বিয়ের উপহার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

ঈদে কেক লাপিস চাই-ই চাই!

সারাওয়াক থেকে কুয়ালালামপুরে বসবাসরত ফারাজাইলা ওয়াহেত বললেন, “এই কেক আমি সবসময়ই খেতে পছন্দ করি, তবে ঈদে এটি অপরিহার্য। এর টেক্সচার ভারী, স্বাদও অন্য সব কেকের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ।”

বেকার সেরির মতে, “প্রতিবার যখন আমি কেক লাপিস বানাই, তখন মনে হয় যেন আমার ঘরের স্বাদ ফিরে পেয়েছি।”

সেরি কেকের উপরের স্তরে ব্যতিক্রমী চকলেট বাটিক ডিজাইন তৈরি করেন, যা মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী বাটিক শিল্পের সাথে মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে। “বাটিক যেমন মালয়েশিয়ার ঐতিহ্য, কেক লাপিসও তেমনি। তাই আমি দুটিকে একত্রে মিলিয়ে নতুন কিছু তৈরি করতে পছন্দ করি,” তিনি বললেন।

রমজান ও ঈদুল ফিতরে কেক লাপিস কেবল একটি মিষ্টি খাবার নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে ঐতিহ্য, ধৈর্য ও সৃজনশীলতার এক অনন্য প্রতীক। 

সূত্রঃ https://www.bbc.com/travel/article/20240406-kek-lapis-the-most-beautiful-cake-for-ramadan





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত