ঈদের আগে টানা সাত দিনের অবস্থান কর্মসূচির পর পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বকেয়া বেতন, ঈদ বোনাসসহ সব বকেয়া পাওনার দাবিতে টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিক-কর্মচারীরা সমাবেশ করেছেন। আজ সোমবার (৭ এপ্রিল) গাজীপুরের বাসন থানার মোগরখাল এলাকায় টিএনজেড কারখানার সামনে বালুর মাঠে বিকেল ৪টায় তাঁরা এ সমাবেশ করেন।
এর আগে গত ২৯ মার্চ ঢাকায় শ্রম ভবনে শ্রমসচিবের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পরিশোধের জন্য ৮ এপ্রিল পুনরায় বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানান। একই সঙ্গে যত দিন এই গ্রুপের শ্রমিকদের সব বকেয়া পরিশোধ না হবে, তত দিন গ্রুপের ডিরেক্টর শাহিন সাহেব পুলিশের হেফাজতে থাকবেন এবং ঈদের আগে আন্দোলনরত ৩ কারখানার শ্রমিকদের ৩ কোটি টাকা মালিকপক্ষকে দিতে হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।
এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনরত শ্রমিকেরা অবস্থান কর্মসূচি সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করেন এবং ৭ এপ্রিল কারখানার সামনে শ্রমিক সমাবেশের ঘোষণা দেন। উক্ত সমাবেশে অ্যাপারেলস প্লাস ইকো লিমিটেড কারখানার শ্রমিকনেতা শাহীন আলমের সভাপতিত্বে টিএনজেড অ্যাপারেলস কারখানার শ্রমিকনেতা শহীদুল ইসলামের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন অ্যাপারেলস প্লাস ইকো লিমিটেডের শ্রমিক শিউলি, মো. সৌরভ; টিএনজেড অ্যাপারেলসের শ্রমিক মো. রুবেল, সীমা আক্তার এবং মাসুদ; অ্যাপারেলস আর্ট লিমিটেডের শ্রমিক আবদুর রহমান, বেলাল হোসেন এবং বেসিক ক্লটিং লিমিটেডের শ্রমিক মামুন মিয়া।
সমাবেশে সংহতি বক্তব্য দেন লেখক ও গবেষক মাহা মির্জা, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর প্রেসিডেন্ট দিলীপ রায়, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সংগঠক নাইম উদ্দিন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মেঘমল্লার বসু, গার্মেন্টস মুক্তি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্য ইকবাল কবীর, জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক শামীম ইমাম, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সবুজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ বিশ্বাস, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি আ ক ম জহিরুল ইসলাম এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক ড. হারুন উর রশীদ।
সভায় বক্তারা জানান, গত ২৩ মার্চ থেকে তিন মাসের বকেয়া বেতন, ঈদ বোনাসসহ যাবতীয় বকেয়ার দাবিতে ঢাকায় শ্রম ভবনের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিসহ ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি সফলভাবে পালন করা হয়। এর আগেও অ্যাপারেলস প্লাস ইকো লিমিটেডের শ্রমিকদের পাওনা বকেয়া পরিশোধের জন্য মালিকপক্ষ কলকারখানা অধিদপ্তরে উপস্থিতিতে চুক্তি করে। বকেয়া পরিশোধের জন্য মালিকপক্ষ বারবার চুক্তি করলেও তা পরিশোধ করেনি। উল্টো শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নানা রকম মিথ্যাচার করতে থাকে। এবারের অবস্থান কর্মসূচি একটি কারখানার শ্রমিকেরা শুরু করলেও কয়েক দিনের মধ্যে আরও দুটি কারখানার (টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড ও অ্যাপারেলস আর্ট লিমিটেড) শ্রমিক কর্মচারীরা আন্দোলনে যুক্ত হন।
বক্তারা আরও বলেন, ২৫ মার্চে শ্রমিকদের আহ্বানে শ্রম মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশ ব্যাপক আক্রমণ করে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। ছাত্রনেতা দিলীপ রায়কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আক্রমণ করে এবং আহত অবস্থায় থানায় আটকে রাখে। পুলিশি বর্বর আক্রমণে শ্রমিক আমিনুল ইসলামের কোমরের হাড় ভেঙে যায়। তিনি এখনো চিকিৎসাধীন আছেন। মালিকপক্ষের নানা ধরনের ষড়যন্ত্র, পুলিশি আক্রমণের মধ্যেও শ্রমিকেরা আন্দোলন থেকে ন্যূনতম সরেননি; বরং আন্দোলন আরও শক্তিশালী ও সংগঠিত হয়েছে।
বক্তারা আরও বলেন, ২৭ মার্চ শ্রম উপদেষ্টা শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধের জন্য মালিকের গাড়ি-বাড়ি বিক্রি করা হয়েছে বলে যে বক্তব্য দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন, সেটা অসত্য, বিভ্রান্তিকর এবং প্রতারণামূলক। শ্রম উপদেষ্টার এই বক্তব্যের প্রতিবাদে শ্রমিকেরা ভুখা মিছিল করেন। শ্রমিকদের লাগাতার আন্দোলনের চাপে মাত্র ১ কোটি টাকা দিয়ে তারা আন্দোলনরত শ্রমিকদের মধ্যে বিভক্তি তৈরির অপচেষ্টা করে। ওই টাকা দিয়ে শুধু একটি কারখানার শ্রমিকের জানুয়ারি মাসের বকেয়ার ৮০ শতাংশ পরিশোধ হয়। পরে আরেকটি কারখানার এক বছরের ছুটির টাকা বাবদ আনুমানিক ৬০ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হয়। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে প্রকাশ্যে টালবাহানা করতে থাকে।
সভায় জানানো হয়, টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেডের আনুমানিক ৯ কোটি টাকা, অ্যাপারেলস প্লাস ইকো লিমিটেডের আনুমানিক ৭ কোটি টাকা এবং অ্যাপারেলস আর্ট লিমিটেডের আনুমানিক ২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সেখানে ২৭ মার্চ পর্যন্ত মালিকপক্ষ দিয়েছিল মাত্র ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এটাকেই তারা সরকারের সহযোগিতায় সকল শ্রমিকের বকেয়া এবং ঈদ বোনাস দেওয়া হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রচার করতে থাকে। আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারীরা মালিকপক্ষ এবং সরকারের এই ধরনের প্রতারণামূলক বক্তব্যের ফাঁদে পা না দিয়ে বরং স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, সব বকেয়া আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচি চলবেই। তিন কারখানার শ্রমিকেরা আরও ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত অবস্থান গ্রহণ করেন।
বক্তারা বলেন, এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ মার্চ শ্রমসচিবের উদ্যোগে ত্রিপক্ষীয় (শ্রমিকপক্ষ, মালিকপক্ষ ও সরকারপক্ষ) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে শ্রমিক-কর্মচারীদের আনুমানিক ১৮ কোটি টাকা পাওনার বিপরীতে ঈদের আগেই ৩ কোটি টাকা প্রদান, অবশিষ্ট বকেয়া পাওনাদি পরিশোধের লক্ষ্যে ৮ এপ্রিল পুনরায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আশ্বাস দেন সচিব। বৈঠকে মালিকপক্ষ ৩ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটা ভঙ্গ করে ২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা দিয়েছে। এই টাকা পেতেও শ্রমিক-কর্মচারীদের নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
সভায় শ্রমিক প্রতিনিধিরা জানান, এ পর্যন্ত আন্দোলনের চাপে বকেয়া পাওনা আনুমানিক ১৮ কোটি টাকার বিপরীতে শ্রমিকেরা পেয়েছেন মাত্র ৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। মালিকপক্ষ বারবার বলছে, তাদের টাকার অভাবে ব্যবসা বন্ধ হয়ে আছে, শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধের মতো সম্পদ তাদের নেই। সরকারও মালিকপক্ষের এই প্রতারণামূলক অবস্থানকে সায় দিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা দেখি, টিএনজেডের দেওয়া তথ্যমতে, তাদের বার্ষিক ব্যবসা ২৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের, অর্থাৎ এ বছর তারা মোট ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে গেছে। এর মধ্যে এক স্টাইলেক্স করপোরেশন নামে তাদের যে বায়িং হাউস আছে, তাদেরই বার্ষিক ব্যবসা ২ হাজার ২৪৮ কোটি টাকার। সেলসের ৫ শতাংশ লাভ ধরলেও লাভ আসছে ১৫৫ কোটি টাকা, সেলসের ১৫ শতাংশ লাভ ধরলেও টিএনজেড গ্রুপের এ বছরের প্রফিট মোটামুটি ৪৬৫ কোটি টাকা।
সমাবেশে লেখক ও গবেষক মাহা মির্জা বলেছেন, ‘নতুন বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের যা স্বপ্ন ছিল, তা ভঙ্গ হয়ে গেছে যেদিন আমরা দেখলাম শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি, দরিদ্র মানুষকে দেখার কেউ নেই। আমরা দেখলাম, শ্রমিকেরা যখন তাঁদের অধিকারের কথা বলতে শ্রম ভবনে গেলেন, তখন এই শ্রম ভবনের ডিরেক্টর থেকে শুরু করে সকলেই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। নতুন দেশের শ্রমিকেরা ভিখারি না। যাঁদের শ্রমে-ঘামে বাংলাদেশের অর্থনীতি চলে। তাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।’
সমাবেশ থেকে টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিকেরা বকেয়া আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চালানোর আহ্বান জানান।