Homeজাতীয়সংবাদপত্রের চ্যালেঞ্জ

সংবাদপত্রের চ্যালেঞ্জ


জনকণ্ঠ যাত্রা শুরুর সময়েই প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে বিপ্লব সাধন করেছিল দেশের প্রিন্ট মিডিয়ায়। দেশের প্রধান দুটি নদীর ওপর সেতু ছিল না, তাই উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে সড়কপথে ঢাকার কাগজ পৌঁছুতে গোটা দিন লেগে যেত। জনকণ্ঠের মালিক-সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদ অভিনব এক আইডিয়া বের করলেন।

ঢাকায় ছাপানো ঢাকা থেকে পাঠানো সংবাদপত্র নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাঠকেরা সকাল বেলাতেই জনকণ্ঠ হাতে পাবেন, কেননা তাঁদের এলাকাতেই জনকণ্ঠ ছাপানো হবে। ভাবুন একবার, বত্রিশ বছর আগে কী অগ্রসর চিন্তা। বর্তমানে ২০২৫ সালে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, জনকণ্ঠ ইউরোপ-আমেরিকায় ছাপানোর দরকারই নেই; সেসব দেশে অবস্থানরত বাঙালি পাঠকেরা নিউ ইস্কাটনের জনকণ্ঠ ভবনের প্রেসে যে-কাগজ ছাপানো হচ্ছে, অবিকল একই জনকণ্ঠ দূরদেশে বসেই পড়ে নিতে পারছেন।

এক্ষেত্রে ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনই হয়ে উঠেছে মাধ্যম, প্রযুক্তির প্রাগ্রসর মাধ্যম। তাই বলতে পারি, ভিশন থাকলে সহায়ক প্রযুক্তি জেনে নেওয়া যায়। সদিচ্ছা ও উদ্যোগ অদম্য হলে সংবাদপত্রও অভূতপূর্ব কিছু করে দেখাতে পারে।  
সংবাদপত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার কথা ছিল আরেকটি সংবাদপত্রেরই; তবে কথায় বলে নিজেও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া যায়, সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নিজেকে নতুন যুগের নতুন পাঠকের কাছে উত্তীর্ণ করা যায়। তবে প্রশ্ন উঠেছে টেলিভিশন ও অনলাইন নিয়ে। এ দুটো মাধ্যম কি ছাপানো খবরের কাগজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলো? জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের মনে পড়ে যাবে, দেশে টিভি চ্যানেল যখন ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হতে শুরু করলো তখন সংবাদ পড়ার নয়, চোখে দেখারও বিষয় হয়ে উঠল।

ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবেশিত সংবাদে ফুটেজ বদলে যেতে থাকল; নতুন নতুন সংবাদ প্রদর্শিত হতে থাকল। কোনো কোনো বিজ্ঞজন বলে উঠলেন, গেল গেল সব গেল। এখন কে পড়বে সংবাদপত্র। বাসি খবর শোঁকার জন্যে! অথচ উল্টো দেখা গেল, টিভি চ্যানেলগুলো পাঠকের হাতে পৌঁছানোর আগেই সংবাদপত্র বিষয়ে টক শো শুরু করল।

বুদ্ধিমান সাংবাদিকের মতো টিভির কর্তাব্যক্তির জন্যও প্রতিদিন কয়েকটি সংবাদপত্র পাঠ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠল। একইভাবে পত্রিকার ধীমান সম্পাদককেও শুধু দেশী চ্যানেলের ছোটপর্দায় নয়, দিনভর চোখ বিছিয়ে রাখতে হয় আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমের পর্দায় ও ছাপানো পৃষ্ঠায়। বিষয়টি পারস্পরিক। 
আসা যাক, অনলাইন সংবাদ প্রসঙ্গে। গণমাধ্যম বিষয়ে জাতীয় জনমত জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে অতিসম্প্রতি। অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের জন্য জরিপটি করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। গণমাধ্যমের ব্যবহার নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভিত্তিক এ ধরনের জরিপ দেশে এটিই প্রথম। এর আগে এ ধরনের জরিপ কেন করা হয়নি, সেটি একটি প্রশ্ন।

প্রশ্নটি মূলতবি রেখেই বলা যায়, জরিপ না করা হলেও নানা মন্তব্য ও অভিমত বিশ্লেষণ করে সমাজবাস্তবতা সম্পর্কে অনেকটা সঠিক অনুমান করা গিয়েছিল। জুলাই আন্দোলনে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে পাঠক, দর্শক ও শ্রোতাদের মনোভাব জানার জন্য পরিচালিত এ জরিপে বিভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে।

দেখা যাচ্ছে খবরের বাহন হিসেবে প্রচলিত গণমাধ্যমের চেয়ে মোবাইল সেটের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেশি। সামগ্রিকভাবে গণমাধ্যমের ওপর মানুষ আস্থা হারাননি, তবে রাজনৈতিক, সরকারি ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপকে বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জরিপে বলা হয়, মানুষ মুদ্রিত খবরের কাগজ কম পড়লেও সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ পড়ছেন মোবাইলে। জাতীয় দুর্যোগ বা সংকটে তথ্য খোঁজার জন্য এখনো মানুষ চোখ রাখেন টেলিভিশনের পর্দায়। তবে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে রেডিওর প্রাসঙ্গিকতা তলানিতে। 
ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রসারের যুগে মানুষ অনলাইননির্ভর হবে, এটাই স্বাভাবিক। ক্রেতারা অনলাইনে সহজেই নানা পণ্য পেয়ে যান। তার মানে এই নয় যে, পণ্য কেনার জন্য তারা বাজারে যান না। সংবাদপত্রের বিষয়টা অবশ্য ব্যতিক্রম। মুদ্রিত সংবাদপত্র নগদ টাকায় কিনতে হয়, আর অনলাইনে ছাপা পত্রিকার অবিকল কপি বিনামূল্যে মেলে (একটি ছাড়া)। সুতরাং অনলাইনই পাঠকের জন্য লাভজনক।

তাছাড়া সংবাদপত্র ২৪ ঘণ্টায় একবারই প্রকাশিত হয়, দুটি সংস্করণ হয় খুব কম সংখ্যক কাগজেরই। পক্ষান্তরে একই সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সনে কোনো নিউজ সংযোজন-বিয়োজন কিংবা সম্পূর্ণ মুছে দেওয়ার সুযোগ থাকে প্রযুক্তিগত সুবিধার কারণেই। অন্যদিকে ২৪ ঘণ্টাই অনলাইন চালু থাকে এবং সার্বক্ষণিকভাবেই নতুন নতুন সংবাদ পরিবেশনের সুবিধা মেলে। ফলে সংবাদপত্রের তুলনায় অনলাইনের পাঠক বেশি থাকবেই।

সেকারণেই বিচক্ষণ দূরদর্শী সংবাদপত্র-সম্পাদকরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাঠক-চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে সুপরিকল্পনামাফিক সংবাদ পরিবেশন করেন, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং মতামত বিশ্লেষণের ওপর জোর দেন। এমনটি হলে টিভি দর্শকরা সেই সংবাদপত্র বিষয়ে আকর্ষণ বোধ না করে পারবেন না। তবে এটা পরিষ্কার যে, সংবাদপত্রের গোটাটাই যদি অনলাইনে বিনামূল্যেই মেলে, তাহলে ছাপানো পত্রিকা বা প্রিন্ট সংস্করণের প্রচারসংখ্যা হ্রাস পেতে বাধ্য।
সুতরাং জনমত জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭৩ শতাংশ মুদ্রিত সংবাদপত্র পড়েন না, এমন তথ্যে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। তারা নির্দিষ্ট কাগজের অনলাইনেই সংবাদ পড়েন। জরিপে সামগ্রিকভাবে ৮৮ শতাংশ উত্তরদাতা জানান, তারা গণমাধ্যমের জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। তার মানে মোবাইল ফোনে ড্যাটা ব্যবহার করেন।

এ কথা বলার অপেক্ষে রাখে না যে, শিক্ষিত, শিক্ষাবঞ্চিত সব শ্রেণির মানুষের হাতেই রয়েছে মোবাইল ফোন। শুধু সংবাদ পাঠ বা দেখাই তো নয়, মোবাইলের রয়েছে বিচিত্র ব্যবহার। মানুষ প্রযুক্তির সুবিধা নেবেই। আজকের সংবাদ তথা তথ্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী মানুষের কাছে শুধু টেক্সট নয়, বিভিন্ন উপায়েই প্রযুক্তিবান্ধবভাবে কী করে সংবাদ পরিবেশন করা যায়, তার সুগম উপায় বের করা। পাই চার্ট, ছক, কার্টুন, চুম্বক তথ্যগুলো চিত্র সহযোগে উপস্থাপন এবং আরও কিছু চাই যা উদ্ভাবনের অপেক্ষায়।  
কুড়ি বছর আগেও, যখন সাংবাদিকদের পেশাগত অবনমন ঘটেনি, সমাজে মর্যাদা ছিল, মানুষ সত্যসন্ধানে এবং ন্যায়নীতি ও আদর্শের বাহক হিসেবে সাংবাদিকদের ওপর ভরসা করত। তখন সিনিয়রেরা নবীন সংবাদকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিতেন প্রতিবেদন রচনাকালে পাঁচটি ডব্লিউ এবং একটি এইচয়ের কথা। হু, হোয়াট, হোয়াই, হোয়েন, হয়্যার এবং হাউ।

মানে কোনো ঘটনা ঘটলে অত্যাবশ্যকভাবে জানা দরকার ঘটনাটি কে ঘটিয়েছে, কী ঘটেছে, কোথায় কখন ঘটল, কেন ঘটল। এবং কিভাবে ঘটল। এখনো সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে অবচেনভাবে পাঠক এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজেন এবং পেয়েও যান। কিন্তু শুধু তথ্য জানলেই তো আর পাঠকের তৃপ্তি ঘটছে না। তার মনের ভেতরে নানাকৌণিক প্রশ্নের উদয় হবে। প্রাজ্ঞ বার্তা সম্পাদক এটি বিলক্ষণ জানেন, তাই সম্ভাব্য প্রশ্নগুলোর উত্তর যাতে পাঠক পান তার ব্যবস্থাও করে থাকেন প্রতিবেদককে দিয়ে।
উপসংহারে এটা বলা যায়, মানুষ মোবাইলের মাধ্যমে তথ্য জানতে চাইলেও খুব দরকারি প্রতিবেদন সেভ বা প্রিন্ট করে রাখেন। প্রিন্ট করা মানে হার্ড কপি রাখা। ছাপানো সংবাদপত্র তো সেটাই। তাই ছাপানো পত্রিকার পাঠক কমেছে, এমনটা মেনে নিয়েও বলা চলে নতুন পাঠক সৃষ্টি, নিজস্ব পাঠক ধরে রাখা, সার্বিকভাবে পাঠকসংখ্যা বাড়ানো এবং আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে কৌশলী পরিকল্পনা গ্রহণ সময়ের অনিবার্য দাবি।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত