সাংবাদিকতায় নতুন সংযোজন মোজো জার্নালিজম বা মোবাইল সাংবাদিকতা। যেখানে শুধুমাত্র মোবাইল ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই, সম্পাদনা ও পত্রিকা বা টেলিভিশন পর্দায় প্রচার। মোবাইল সাংবাদিকতা দ্রুতই সাংবাদিকতা বিভাগে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরি ও পাঠানোর জন্য। কোনো জায়গাতে ঘটনা ঘটলে দ্রুত সরেজমিনে উপস্থিত হওয়া যেমন সহজ হয়েছে তেমনি তাৎক্ষণিক জনসাধারণের কাছে সংবাদ পৌঁছিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
তারই ধারাবাহিকতায় প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাককানইবি) সংবাদদাতাদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে মোবাইল সাংবাদিকতা বিষয়ক তিন দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করেছে। ৬-৮ মার্চ রাজধানীর পিআইবি সেমিনার কক্ষে ওই কর্মশালার উদ্বোধন করা হয়।
পিআইবিতে প্রশিক্ষণ কর্মশালা উপলক্ষে বাকৃবি সংবাদদাতারা খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন নতুন কিছু শেখার প্রত্যয়ে। আমাদের যাত্রা শুরু হয় ৫ মার্চ, এজন্য সকলে বিকাল ৪টার মধ্যে ক্যাম্পাসে সমিতির সামনে জড়ো হয়। এরপর বিকাল সাড়ে ৪টায় অগ্রজ-অনুজ সদস্যরা একসাথে রওনা হলাম ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনে, পৌঁছালাম ৫টার সময়। ঢাকার উদ্দেশ্যে ট্রেন বিকাল সোয়া ৫টায় প্রস্থান করলো। এবারের আমাদের ভ্রমণ হবে ট্রেনে, ভাবতেই এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করেছে। ট্রেন ভ্রমণ মানেই চিরহরিৎ ঘন গাছপালা ভেদ করে সাই সাই করে আগানো। প্রিয় মানুষদের সাথে আনন্দঘন মুহূর্ত ভাগাভাগি করা। এরই মাঝে সমিতির অগ্রজ সদস্যরা খোস গল্পে মেতে উঠলেন, আমরা নবীনরাও সাথে যোগ হলাম। ট্রেন ভ্রমণে এবারে ভিন্ন জিনিস পাওয়া, এই প্রথম ট্রেনের মধ্যে রোজার ইফতার করা। সবার সহযোগিতাপূর্ণ ব্যবহার, ইফতার ভাগাভাগি করে ইফতার সম্পন্ন একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছায়, সেখান থেকে পিআইবিতে যাওয়া। সেখানকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আমাদেরকে থাকার রুম বুঝিয়ে দেন। পিআইবিতে আরও একটি বড় পাওয়া, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকেরা একসাথে সাহ্রী ও ইফতারি করা। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ২৮জন সংবাদদাতা একসাথে সাহরি ও ইফতারি করা এক অনন্য পাওয়া, সবার মাঝে এক আত্মিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এবার আসি প্রশিক্ষণ বিষয়ে, ৬ মার্চ সকাল থেকে আমাদের কাক্সিক্ষত প্রশিক্ষণ কর্মশালা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিআইবি মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ।
প্রশিক্ষণ কর্মশালার কতগুলো দক্ষ, সাহসী, আন্তরিক ও উদ্যমী প্রশিক্ষক ছিলেন। তারা আমাদের মোবাইল সাংবাদিকতা আদ্যোপান্ত বোঝান। মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করে দ্রুত সময় প্রতিবেদন তৈরির কৌশল, মক সেশন, ব্যবহারিক ক্লাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেন। ডিভাইস ব্যবহার করে ফটোগ্রাফি করতে বিভিন্নভাবে সুন্দর ফটো ফ্রেমিংয়ে ছবি তোলা যায়, স্টোরি টেলিংয়ে গতানুগতিক থেকে নতুন ভাবে চিন্তা করা যায় এনিয়ে দিক নির্দেশনা দেন। প্রশিক্ষণ কর্মশালার সবচেয়ে আকর্ষণীয় সেশন ছিল দ্বিতীয় দিন (৭ মার্চ)। প্রশিক্ষকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদেরকে ভিডিও প্রতিবেদন করতে হবে। এজন্য আমাদেরকে ৪ জন করে মোট ৭টি টিম করে দেন। সকলের মাঝে উচ্ছ্বাস ও আন্তরিকতা ছিল, বের হয়ে পড়লো ঢাকার রাস্তায় ভিডিও প্রতিবেদন করতে। সকলের আলাদা আলাদা বিষয়ে প্রতিবেদন করার তীব্র আগ্রহ। কেউ সবজি বিক্রেতার জীবন-চিত্র, কেউ ডাব বিক্রেতার আর্থিক অবস্থা, কেউবা ঢাকার রাস্তায় শুয়ে থাকা অসহায় বৃদ্ধ মানুষের ইচ্ছাগুলো নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলো। আমাদের দলের বিষয় ঠিক করি এক অসহায়, বেইলি রোডের ডিভাইডারের উপর শুয়ে থাকা দুস্থ হাবিবুরের কথা। তার জীবনের যান্ত্রিকতা আমাদের প্রতিবেদনে ফুটিয়ে তুলি। তিনি এক সময় ঢাকার রাস্তায় জাঁদরেল ট্রাক চালক ছিলেন। কিন্তু ‘একটি দূর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না’, ট্রাক দূর্ঘটনায় এখন পঙ্গুত্ব বরণ। পরিবারের লোকজন চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনে অক্ষম এজন্য চলে আসেন ঢাকায়, কোনো সুহৃদয়বান ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণে। হাবিব আবারো ঢাকার রাস্তায় ট্রাক চালাতে চান। সর্বোপরি দিনটি অনেক উপভোগ্য ছিল, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকেদের মাঝে পেশাগত প্রতিবেদন বানানোর তীব্র প্রচেষ্টা ছিল।
প্রশিক্ষণ কর্মশালার শেষ দিনে (৮ মার্চ) সমাপনী অনুষ্ঠানে পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক ও পিআইবি পরিচালনা বোর্ডের সদ্যস শামছুল হক জাহিদ। মোজো জার্নালিজম সম্পর্কে সামছুল হক জাহিদ বলেন, ‘মোজো জার্নালিজমে এখন ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল। একটি গবেষণায় দেখা গেছে বর্তমান বেশির ভাগ নিউজ জানার মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। আশা করি ভবিষ্যতে এর সঠিক ব্যবহার করবেন। টেকনোলজির দিকেও নজর দিয়ে তা আত্তস্থ করার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে মজো জার্নালিজমে কাজে লাগবে। মোজো জার্নালিজমের আরেক নাম মজার সাংবাদিকতা।’ ৩ দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার স্মৃতিচারণ করে বাকৃবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান রনি বলেন, ‘পিআইবি এর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ এত সুন্দর প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করার জন্য। অনেক সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুবর্তী ছিল। আমরা এখান থেকে শিক্ষণীয় দিকগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতায় কাজে সর্বোচ্চভাবে লাগানোর চেষ্টা করবো।’