Homeজাতীয়শত বছর আগের ঐতিহ্য আর আধুনিকতার বর্ণিল চিত্র

শত বছর আগের ঐতিহ্য আর আধুনিকতার বর্ণিল চিত্র


ঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান।

মুঘল আমলের জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ উদ্‌যাপন

মুঘল আমলে ঢাকার ঈদ ছিল আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠান। বাদশাহদের ঈদ উদ্‌যাপনের চিত্র ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশাল আকারের হাতি আনা হতো, এবং বাদশাহরা হাওদার ওপর রাখা রত্নখচিত শৈল্পিক কেদারায় আসীন হতেন।

হাতিযোগে বাদশাহ এবং পদব্রজে রাজকর্মচারীরা দিল্লির ঈদগাহের দিকে যাত্রা করতেন, যা ছিল এক রাজকীয় শোভাযাত্রা। এই জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য মুঘলদের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল। তবে এই জাঁকজমকপূর্ণ উদ্‌যাপন মূলত মুঘল বাদশাহ, সুবেদার ও বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সাধারণ মানুষেরা এতে তেমনভাবে অংশ নিতে পারতেন না।

গণমানুষের ঈদ: ঐতিহ্যের নবযাত্রা

ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ঢাকার ঈদ উৎসব সাধারণ মানুষের জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে। এটি কেবল অভিজাত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে মুঘল আমলের ঈদ ঐতিহ্যের কিছু কিছু রীতি আজও দেখা যায়, যা তাদের শৈশবের স্মৃতিতে অমলিন।

চাঁদ দেখার ঐতিহ্য: বুড়িগঙ্গার রূপকথা

ঢাকার চাঁদ দেখার ঐতিহ্যের সঙ্গে বুড়িগঙ্গা নদীর এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। একটা সময় ছিল, যখন ঢাকার মানুষ বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ পানিতে ঈদের চাঁদ দেখতেন। দিল্লির লালকেল্লায় চাঁদ দেখার খবর পৌঁছানোর পর তোপধ্বনি করা হতো, যা শহরবাসীকে ঈদের আগমনী বার্তা দিত। তবে সময়ের পরিবর্তনে এই তোপধ্বনি এখন হারিয়ে গেছে।

ঐতিহাসিক ঈদগাহ ও ঈদ মিছিল: ঐতিহ্যের ধারক

ঢাকার ঐতিহাসিক ঈদগাহগুলোর মধ্যে ধানমন্ডির ঈদগাহ অন্যতম, যা ১৬৪০ সালে নির্মিত হয়েছিল। এখানে সুবা বাংলার সুবাদার, নায়েবে নাজিম এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ঈদের নামাজ আদায় করতে আসতেন। ঢাকার ঈদ মিছিল ছিল এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। মিছিলে সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি এবং হাতে অস্ত্র নিয়ে সৈন্যরা অংশ নিত। এই মিছিল ঢাকার মানুষের জন্য বিশেষ আকর্ষণ ছিল, যা দেখার জন্য তারা রাস্তার দুই পাশে ভিড় করত।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঈদ মিছিল: সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি

ঈদ মিছিল শুধু ধর্মীয় আনন্দ উদ্‌যাপনের মাধ্যম ছিল না, এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতার বিষয়ও জড়িত ছিল। মিছিলে সমাজের বিভিন্ন অসংগতি ও শাসকদের ব্যর্থতা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হতো। বর্তমানে ‘ঢাকাবাসী’ নামের একটি সংগঠন এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে, তবে তারা নাগরিক সমস্যা নিয়ে স্লোগান ব্যবহার করে।

১৯৫৪ সালে ঢাকায় ঈদের জামাত, জেমস বার্কের তোলা

১৯৫৪ সালে ঢাকায় ঈদের জামাত, জেমস বার্কের তোলা

ঈদের খাবার ও খাদ্যাভ্যাস: ঐতিহ্যের স্বাদ

ঈদের খাবারের ঐতিহ্যে পুরান ঢাকার মানুষের এক বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। ঈদের সকালে দুধ ও খোরমা খাওয়া মুঘল আমলের একটি ঐতিহ্য, যা আজও অনেক পরিবারে প্রচলিত। এ ছাড়া পোলাও, বিরিয়ানি, কোরমা এবং বিভিন্ন ধরনের মাংসের পদ ঈদের খাবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে, এবং ঐতিহ্যবাহী অনেক খাবার হারিয়ে যেতে বসেছে।

সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: আধুনিকতার ছোঁয়া

ঢাকার ঈদ উৎসবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। চকবাজারের ঈদ মেলার ঐতিহ্য এখনো কিছুটা টিকে থাকলেও এর জৌলুশ আগের মতো নেই। কাসিদা ও কাওয়ালির মতো ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবেশনা এখন প্রায় বিলুপ্ত। আধুনিক গান ও অন্যান্য বিনোদনের মাধ্যম এই স্থান দখল করেছে।

এক সময় ঈদের দিন পুরান ঢাকায় ভোরে কাসিদা গাইতেন মানুষ। এখন হারিয়েছে সে প্রথা। প্রতীকী ছবি

এক সময় ঈদের দিন পুরান ঢাকায় ভোরে কাসিদা গাইতেন মানুষ। এখন হারিয়েছে সে প্রথা। প্রতীকী ছবি

ঐতিহ্যের সংরক্ষণ: আগামীর পথে

ঢাকার ঈদ উৎসবের ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ হলেও কালের প্রভাবে এর অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি।

এবার দীর্ঘ দিন পর ঈদ আনন্দ শোভাযাত্রা হয়েছে ঢাকায়। ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি ছিল এই শোভাযাত্রায়। এতে মুঘল আমলের আদলে বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করা হয়। এই ঈদ শোভাযাত্রায় অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজসহ সর্বস্তরের মানুষ। এটি আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

আজ সোমবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠের সামনে থেকে এ আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়। শোভাযাত্রাটি আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়ক দিয়ে খামারবাড়ি মোড় হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে গিয়ে শেষ হয়।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত