বৃহস্পতিবার বইমেলায় ঢুকতেই চোখে পড়ল একদল তরুণ-তরুণী। মেয়েদের মাথায় ফুলের টায়রা, পরনে হলুদ-লাল শাড়ি। হাতে জড়ানো হলুদ গাঁদা ফুলের মালা। কারও মুঠোয় লাল গোলাপ কিংবা জারবেরার তোড়া। ছেলেদের কারও কারও পরনে পাঞ্জাবি। নানাভাবে পোজ দিয়ে ছবি তুলছিলেন উচ্ছ্বল ওই তরুণ-তরুণীরা।
আজ বসন্ত ঋতুর প্রথম মাস ফাল্গুনের প্রথম দিন। গতকাল ছিল মাঘের শেষ। এক দিন আগেই কাল বইমেলায় বয়ে গেল ফাগুন হাওয়া। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফসান হাসান তাঁর বন্ধুর ছবি তুলে দিচ্ছিলেন। বললেন, ‘আমরা উৎসব পছন্দ করি। ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। বইমেলায় সেই আনন্দ আরও বেশি হয়। বসন্ত আসবে ঘুরতে বের হব না, তা তো হয় না।’
বর্ণিল পোশাক পরে মেলায় ঘোরাঘুরি করা ফুর্তিবাজদের অনেককে বইও কিনতে দেখা গেছে কাল। কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী জারিন তাবাসসুমের হাতে রকিব হাসানের রহস্য-রোমাঞ্চের বই ‘লাল পাহাড়ের আতংক’। বান্ধবীদের বলছিলেন জারিন, এ বইটা শেষ হলেই রকিব হাসানের সব বই পড়ে ফেলা হবে তাঁর। রহস্য-রোমাঞ্চ আর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি তাঁর কতটা পছন্দ–এ কথাতেই স্পষ্ট।
ফরিদপুর থেকে এসেছেন তিন বন্ধু দেবাশীষ কর, তামিম হাসান আর হাসিবুল ইসলাম। সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র সবাই। তিন বন্ধু জানালেন, ধ্রুপদি সাহিত্যের কয়েকটি কিনেছেন তাঁরা। তার মধ্যে বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ দাশের বই আছে। এ ছাড়া চলচ্চিত্রের কৃতী মানুষ মৃণাল সেন ও চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে বই কিনেছেন। বই আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের অন্যরকম পরিবেশ–এ দুয়ের টানে দূর হলেও মেলায় আসেন তাঁরা।
গতকাল বইমেলায় ভিড় খুব একটা ছিল না। তবে দর্শনার্থীদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা ছিল বেশি। বই কতটা বিক্রি হচ্ছে তার খবর জানালেন ইউপিএলের বিক্রয়কর্মী নুরুল ইসলাম। বললেন, ‘মোটামুটি বিক্রি হচ্ছে। বেশির ভাগই তো ছবি তোলে, খাওয়াদাওয়া করে চলে যায়। বই কেনার পাঠক আলাদা। তাদের কম দেখতে পাচ্ছি আজ।’
নতুন বইয়ের খোঁজে
সিরাজ সিকদার বাংলাদেশে কট্টর বামপন্থী রাজনীতির এক আলোচিত চরিত্র। ১৯৬৮ সালে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তখনকার অতি দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রামে ছিল সিরাজ সিকদার এবং তাঁর সংগ্রামী তৎপরতার এক অজানা অধ্যায়। সেই অধ্যায়কেই পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির তিন সদস্য সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, অনন্ত সিংহ ও অং চিং। ‘পাহাড়ের লাল আখ্যান: পার্বত্য চট্টগ্রামে সিরাজ সিকদার ও পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি’ নামের এই বই প্রকাশ করেছে আদর্শ।
দেশভাগ পরবর্তী বাংলার সাত কবির কাব্য ভাষা নির্মাণ আর তাঁদের শিল্প-সাহিত্যের পথচলা নিয়ে ‘আড়ে বিভঙ্গে বিচার’ নামের বইতে আলোচনা করেছেন আবুল ফজল। বইটিতে আলোচিত কবিরা হলেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার ও উৎপলকুমার বসু। প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ।
পারিবারিকভাবে সংগীত শিক্ষা এবং গুরুশিষ্য পরম্পরায় সংগীতের তালিম নিয়ে রীনাত ফওজিয়ার বই ‘গুরুশিষ্য পরম্পরায় ওস্তাদ খুরশিদ খান’ প্রকাশ করেছে মেঘদূত প্রকাশনী। সেতার শিল্পী রীনাত ফওজিয়া সংগীতের তালিম নিয়েছেন ফুফাতো ভাই ওস্তাদ খুরশিদ খানের কাছে। ওস্তাদ খুরশিদ খান প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলী খানের নাতি।
গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ৮৫টি। এ পর্যন্ত মোট বই প্রকাশিত হয়েছে ১ হাজার ২টি।
আয়োজন
গতকাল মূলমঞ্চে ছিল ‘ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান : প্রেক্ষাপট ও অভিমুখ’ শীর্ষক আলোচনা। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সারোয়ার তুষার। আলোচনা করেন যোবায়ের আল মাহমুদ এবং নুসরাত সাবিনা চৌধুরী। সভাপতি ছিলেন মাহবুব মোর্শেদ।
সারোয়ার তুষার বলেন, এ অঞ্চলের প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক পর্বে ছাত্রসমাজ এগিয়ে এসেছে এবং রাজনৈতিক পরিণতির অভিমুখ নির্ধারণ করেছে। বৃহত্তর জনগণ ছাত্রশক্তির ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয়ী ছাত্রশক্তি এ ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন। তাই এবার তারা রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন করতে চায়।
লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি ফাতিমা তামান্না এবং কবি মুহাম্মদ আবদুল বাতেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী রবিউল আলম ও নাসিম আহমেদ। গতকাল ছিল শাকিল আহমেদের পরিচালনায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি সংসদ’ এবং সারমিন ইসলাম জুঁইয়ের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘ঋদ্ধস্বর আবৃত্তি একাডেমি’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, অনন্যা আচার্য, ফাহমি ফেরদৌস, ফারহানা শিরিন, সঞ্জয় কবিরাজ, নিপা ভট্টাচার্য, ইন্দিরা রুদ্র এবং কাজী মুয়ীদ শাহরিয়ার সিরাজ জয়।
আজ শুক্রবার অমর একুশে বইমেলার ১৪তম দিনে মেলা শুরু হবে বেলা ১১টায়। শবে বরাত উপলক্ষে রাত ৯টার পরিবর্তে মেলা চলবে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। আজ বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: আহমদ ছফা’ শীর্ষক আলোচনা। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন তাহমিদাল জামি। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন নূরুল আনোয়ার এবং সাজ্জাদ শরিফ। সভাপতিত্ব করবেন সলিমুল্লাহ খান।