রোজা ঘনিয়ে এলেই শুরু হয় খেজুর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যায় ইফতারির অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুরের দাম। কয়েক বছর ধরে এমন প্রবণতাই দেখা গেছে বাজারে। তবে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে এবার। গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ‘খেজুর মাফিয়া’ সিন্ডিকেট ভেঙে পড়ায় আমদানিতে উৎসাহ ফিরে পেয়েছেন ছোট আমদানিকারকেরা। এতে কিছুটা কমেছে খেজুরের দামও।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে খেজুর আমদানি ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী। তাঁরাই নির্ধারণ করতেন এর বাজার। সরকার পতনের পর মদিনা গ্রুপের কর্ণধার আওয়ামী লীগ নেতা হাজি মোহাম্মদ সেলিম ও নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলামের মতো তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ শক্তিশালী সিন্ডিকেট শিরোমণিরা বর্তমানে কারাগারে। তাই এবার ছোট ছোট আমদানিকারক খেজুর আমদানিতে মনোযোগী হয়েছেন। এ কারণে গত বছরের তুলনায় এবার আমদানি বেশি হয়েছে। এ ছাড়া সরকারও সব ধরনের খেজুরে অগ্রিম কর অব্যাহতি, কাস্টমস ডিউটি ও অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়েছে। এতে খেজুরের মূল্য ক্ষেত্রবিশেষে সর্বোচ্চ ৪৪৫ টাকা পর্যন্ত কমেছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের আইনবিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, এবার খেজুরের বাজার একেবারে ঠান্ডা। অন্যবার সিন্ডিকেট করে কয়েকজন ব্যবসায়ী পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন। এবার তাঁরা হয় কারাগারে, নয়তো আত্মগোপনে। ছোট ব্যবসায়ীরা এবার খেজুর আমদানির সুযোগ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি খাতুনগঞ্জের মজুমা ট্রেডার্স ও আমানত এজেন্সির মতো ছোট ছোট আমদানিকারককে উদাহরণ হিসেবে সামনে এনেছেন।
এদিকে রোজা সামনে রেখে খেজুরের আমদানি বাড়ার পেছনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কিছু উদ্যোগও কাজে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চট্টগ্রাম কাস্টমস ও এনবিআরের তথ্যমতে, অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ও শুল্ক-কর বাড়ানোয় গত বছর অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল খেজুরের দাম। গত বছর ভালো মানের প্রতি কেজি খেজুরে ৪ ডলার, মাঝারি মানের খেজুরে ৩ ডলার, কম ভালো মানের খেজুরে ২ দশমিক ৫০ থেকে ২ দশমিক ৭৫ ডলার এবং নিম্নমানের খেজুরে ১ ডলার আমদানি মূল্য হিসাব করে (অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু) শুল্ক আদায় করত এনবিআর। এবার অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়ে আনা হয়েছে।
আমদানিকারদের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে বস্তায় করে আমদানি হওয়া নরম খেজুরের ক্রয়মূল্য প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭৪ টাকা। কিন্তু গত বছর ১২০ টাকা (১ ডলার) অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ধরে শুল্কায়ন করে এনবিআর। একইভাবে গত বছর প্রতি কেজি নিম্নমানের খেজুরে ব্যবসায়ীদের শুল্ক পরিশোধ করতে হয়েছে ৬৪ টাকা ৪১ পয়সা। এরপর বাজারে পৌঁছতে প্রতি কেজি খেজুরে খরচ পড়ে ১৩৮-১৪০ টাকা। পাইকারি ও খুচরায় হাত বদলে ভোক্তাকে তা কিনতে হয়েছে ২০০ টাকায়। বর্তমান সরকার সব ধরনের খেজুরের দাম কমানোর জন্য আগের ৫ শতাংশ অগ্রিম কর বাদ দিয়েছে। কাস্টমস ডিউটি ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে এবং অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়ে এনেছে। এতে পণ্যটির আমদানি মূল্য কমেছে। গত বছরের তুলনায় বেড়েছে আমদানিও।
এনবিআরের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জুলাই থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে সাত মাসে ৪৪ হাজার ২৫৩ টন খেজুর আমদানি হয়েছে। অথচ গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) একই সময়ে খেজুর আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২০ হাজার ২৬৩ টন। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৮৬ হাজার ৫৮১ টন। বাংলাদেশে মূলত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়া, মিসর, জর্ডান, ইরাক, ইরান ও পাকিস্তান থেকে বেশির ভাগ খেজুর আমদানি হয়।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) তথ্যমতে, দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা ৬০ থেকে ৯০ হাজার টন। শুধু রমজান মাসে ৪০ হাজার টন খেজুর প্রয়োজন হয়। খেজুর আমদানির তথ্য অনুযায়ী এবারের রমজানে সংকট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও কদমতলী ফলের পাইকারি বাজার ফলমন্ডির আর এন জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী রহমত আলী জানান, বর্তমানে সৌদি আরবের মাবরুম খেজুর প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০ টাকা দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। এ ক্ষেত্রে গতবারের তুলনায় এবার দাম কমেছে ৪০০ টাকা। গত বছর সৌদি আরব থেকে আমদানি হওয়া আজওয়া খেজুর মানভেদে প্রতি কেজি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এবার আজওয়া বিক্রি হচ্ছে ৬৪০-৮০০ টাকায়। মিসর থেকে আমদানি হওয়া প্রতি কেজি মেডজুল খেজুর এবার বিক্রি হচ্ছে ৯২০-৯৬৫ টাকায়, যা গত বছর ছিল ১২০০-১৪০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি মেডজুল খেজুরের দাম কমেছে ৪৪৫ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে জায়েদি (ইরাক) গত বছরের তুলনায় কেজিতে ১৭০ টাকা কমে বর্তমানে ৩৫০-৩৭০ টাকা, নাগাল (ইরাক) খেজুর ১৬০ টাকা কমে ৫৬০-৫৭০ টাকা, দাব্বাস (ইরাক) খেজুর ১৬০ টাকা কমে ৭০০ টাকা ও ছররা (তিউনিসিয়া) খেজুর ১৪০ টাকা কমে ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে কম দামি খেজুর যেটি বস্তায় আমদানি হয় বলে বাজারে বস্তা (নরম) খেজুর নামে পরিচিত, সেটিও গত বছর প্রতি কেজি ১৫৫-১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এবার কেজিতে ৩৫ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০ টাকায়।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন জানান, গত বছর একদিকে যেমন খেজুর কম আমদানি হয়েছিল, অন্যদিকে খেজুরের শুল্কায়নও যথাযথ ছিল না। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল নিম্নবিত্তরা। এবার শুল্ক কমানোর ফলে আসন্ন রমজানে খেজুরসহ বেশির ভাগ পণ্যের দাম সহনশীল থাকবে বলে আশা করছেন ক্যাবের এ নেতা।