ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম অপরিকল্পিতভাবে এবং নানা সীমাবদ্ধতা ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিবন্ধনের কাজ শুরু হলেও এখনো মাঠপর্যায়ে কোনো আর্থিক বরাদ্দ দেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রয়েছে পুরোনো যন্ত্রপাতির সমস্যা আর জনবলের অভাবও। নিবন্ধন করতে যাওয়া সাধারণ মানুষ এবং ইসির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
নির্বাচন কমিশন গত ২০ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করেছে। সে কর্মসূচির বিষয়েও নাগরিকদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছিল। এখন ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চলছে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটার নিবন্ধনের কাজ।
মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হওয়ার পর নানা সীমাবদ্ধতা সামনে আসছে। ইসি থেকে বলা হয়েছে, কেন্দ্রে গিয়েও ফরম পূরণ করে নিবন্ধন করা যাবে। ফলে অনেকেই ভোটার হওয়ার জন্য নিবন্ধন কেন্দ্রে যাচ্ছেন। তবে ভোটার হওয়ার জন্য জন্মসনদসহ যত নথি লাগে, নিবন্ধন কেন্দ্রে তা যাচাই করার সময় নেই। এ কারণে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। নিবন্ধন কার্যক্রমে ব্যবহৃত ৩০টির মতো উপকরণ নগদ অর্থে কিনতে হয়। সময়মতো বরাদ্দ না পাওয়ায় আপাতত নিজের টাকায় এগুলো কিনতে হচ্ছে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের।
নিবন্ধনের কাজে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু কারিগরি সমস্যা। মাঠপর্যায়ে ল্যাপটপ এবং আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশের ছবি নেওয়ার যেসব যন্ত্র পাঠানো হয়েছে, তার বেশির ভাগ পুরোনো। কোনোটি কোনোটি কাজের মধ্যে ‘হ্যাং’ (অচল) হয়ে পড়ছে। ডেটা এন্ট্রির ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। কর্মকর্তাদের কারও কারও দিনের কাজ শেষ করতে রাত ১২টা পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে।
ঢাকা অঞ্চলের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখনো কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। নিবন্ধনের জন্য সময় কম দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি পুরোনো। ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের বেশির ভাগ নতুন ও অদক্ষ।
ফরিদপুর অঞ্চলের একজন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জানান, একটি কেন্দ্রে ৫০০ থেকে ৬০০ জনের নিবন্ধনের জন্য এক দিন, এক হাজার জন হলে দুই দিন সময় দেওয়া হয়। তিনি ১২টি ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছেন। এর মধ্যে ১০টিই পুরোনো।
সরেজমিন অভিজ্ঞতা
১৭ ফেব্রুয়ারি আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিরা দেশের কয়েকটি স্থানে নিবন্ধনপ্রক্রিয়ার পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে যান। সেখানে তাঁরা কাজের ধীরগতি, যান্ত্রিক সমস্যা ও সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তির মতো বিভিন্ন সমস্যার চিত্র দেখেন।
পুরোনো ঢাকার কোর্ট হাউস স্ট্রিটে অবস্থিত রাজার দেউরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, সকাল ১০টা থেকে দুটি ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছেন ডেটা এন্ট্রি অপারেটররা। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের এখানে পাঁচজন কর্মী দেওয়ার কথা ছিল। আছে মাত্র দুজন।’
রাজার দেউরী বিদ্যালয়ের নিবন্ধন কেন্দ্রে এ প্রতিবেদকের কথা হয় শিপ্ত কর্মকারের সঙ্গে। অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছবি তুলতে গেলে ক্যামেরা হ্যাং হয়ে গিয়েছিল। পরে ল্যাপটপ রিস্টার্ট করে ছবি তুলেছেন।
দুপুর ১২টার দিকে সূত্রাপুরের কাপ্তান বাজারে অবস্থিত নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভোটার নিবন্ধন করতে আসা মানুষে মাঠ পরিপূর্ণ। সেখানে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কলেজশিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৯টায় কেন্দ্রে এসে দুপুর সাড়ে ১২টায় নিবন্ধন সম্পন্ন করতে পারলাম।’
নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে নারী ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রমের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, হাত ঘামে এমন নারীদের আঙুলের ছাপ নিচ্ছে না যন্ত্র। কলেজশিক্ষার্থী সুমাইয়া ওয়াহিদ নওশিন জানান, হাত ঘামায় শুধু আঙুলের ছাপ দিতে তাঁর সময় লেগেছে ১০ মিনিট।
যাত্রাবাড়ী সিটি করপোরেশন আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে উপস্থিত নিবন্ধনে আগ্রহী কয়েকজন লোকবল বাড়ানোর পরামর্শ দিলেন। সজল নামের এক যুবক জানান, সকাল ৮টায় এসেও তাঁর প্রায় দেড় ঘণ্টা লেগেছে।
ঢাকা জেলার দোহার পৌরসভায় অবস্থিত জয়পাড়া সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজে নিবন্ধন করতে আসা তাজেল হোসেন বলেন, ‘৯টা ওয়ার্ডের লোকজনের ছবি একসঙ্গে তোলার জন্য অনেক ভোগান্তি হচ্ছে। অনেকক্ষণ লাইনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’
ছবি তোলার দায়িত্বে থাকা আশিকুল রহমান জানান, কম্পিউটার ও ডিভাইসে লিখতে হয় বলে একটু সময় বেশি লাগছে। এ ছাড়া কম্পিউটারে মাঝে মাঝে একটু সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
রাজশাহী নগরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বালাজান নেসা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে নতুন ভোটার হতে আসা সাফিয়া খাতুন বলেন, চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পা ব্যথা করছে।
নগরের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত নির্বাচন কর্মকর্তা অঞ্জন কুমার রায় বললেন, ভোটারের বায়োমেট্রিক, স্বাক্ষর নেওয়া, ছবি তোলা ছাড়াও নামসহ ২০ ধরনের তথ্য পূরণ করতে হচ্ছে। তা ছাড়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট হালকা হয়ে যাওয়া কিংবা ঘামের কারণে শতকরা প্রায় ২০ ভাগ নারীর আঙুলের ছাপ নিতে সমস্যা হচ্ছে। ডেটা এন্ট্রি অপারেটররা নতুন বলে তাঁরাও কাজে কিছুটা সময় বেশি নিচ্ছেন।
চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নতুন ভোটার হিসেবে সন্তানের নিবন্ধন করাতে এসেছিলেন আব্দুল কাইয়ুম। তিনি জানান, তাঁর ছেলেকে দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। একজন অপারেটর বলেন, বায়োমেট্রিক গ্রহণে একটু সময় লাগছে। অনেকের আঙুলের রেখা মুছে যাওয়ায় মেশিন একবারে নিচ্ছে না।
চট্টগ্রাম জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মো. বশির আহমেদ জানান, আগে ডিভাইসের সমস্যা থাকলেও তা ঠিক হয়ে গেছে। এখন সমস্যা হচ্ছে বায়োমেট্রিক গ্রহণে।
সোমবার দুপুরে রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে গিয়ে ওপরতলা থেকে নিচতলায় বারবার ওঠানামা করতে দেখা যায় নতুন ভোটার হতে আসা তরুণ নাহিদ হোসেনকে। কথা বলে বোঝা গেল, লেখাপড়া না জানা নাহিদ হোসেন কোথায় কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। দেড় ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরে যান তিনি। যাওয়ার আগে নির্বাচন অফিসের সামনে নাহিদ বলেন, দায়িত্বরত একজনকে কাগজপত্র দেখালে তিনি তা ফটোকপি করতে বলেন। ফটোকপি করার পর দোতলায় যেতে বলা হয়। সেখান থেকে আবার নিচতলায় যেতে বলা হয়। একপর্যায়ে বলা হয়, সেখানে তাঁর নামের নিবন্ধন হবে না। নাহিদকে যোগাযোগের জন্য একটি মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া হয়। তবে বারবার ফোন দিয়েও তা বন্ধ পেয়ে হতাশ নাহিদ ফিরে যান।
বেলা ১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নতুন ভোটার নিবন্ধন করতে হতাশ হয়ে এসে ফিরে যাওয়া রংপুর নগরীর নুরপুর এলাকার বাসিন্দা মো. নুরুজ্জামান, গণেশপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল ওয়াহেদসহ অন্তত ১০ জনের সঙ্গে আজকের পত্রিকার প্রতিনিধির কথা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মমিনুর আলম বলেন, নির্বাচন অফিসে ভোটার নিবন্ধনের সুযোগ নেই। কারণ, এখানে কোনো ডিভাইস নেই। বাদ পড়া ব্যক্তিরা ১৯ থেকে ২০ মার্চ কেরামতিয়া হাইস্কুলে এলে নিবন্ধন করে দেওয়া হবে।
১৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মাসিক সমন্বয় সভায় জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক; ঢাকা ও ফরিদপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা; চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে যন্ত্রপাতির স্বল্পতা এবং কারিগরি সমস্যার সমাধান করা না হলে নির্ধারিত সময়ে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করার ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ এস এম হুমায়ুন কবীর কয়েক দিন আগে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খুব ছোট ছোট দু-একটি আর্থিক বরাদ্দ আমরা দিয়েছি। মূল বরাদ্দের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। দুজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে গিয়েছেনও। আশা করছি, খুব শিগগির তা হয়ে যাবে। তখন মাঠপর্যায়ের বরাদ্দটা দেওয়া হবে।’
পুরোনো যন্ত্র এবং কম সময়ে কাজ করার চাপের বিষয়ে মহাপরিচালক বলেন, ‘আসলেই এগুলো ঘটছে। একজন মানুষ যদি সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করেন, তিনি কি পরের দিন পুরো উদ্যমে কাজ করতে পারবেন? এ বিষয়গুলো নিয়ে কমিশনে আলোচনা হয়েছে। এখনো সিদ্ধান্ত না হলেও আশা করি ইতিবাচক কিছু হবে।’
- প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, দোহার এবং রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার প্রতিনিধি।