অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে আগামী শুক্রবার এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। চীন বৈঠকটিকে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক করে রাখতে চায়। অন্যদিকে সির সঙ্গে বৈঠকের পর সপ্তাহ না গড়াতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও ইউনূসের সাক্ষাতের সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশে গত আগস্টে ক্ষমতায় পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক, কৌশলগত, বাণিজ্যিক ও সামরিক দিক থেকে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ইউনূসের বৈঠক হতে চলেছে, এ কারণে বৈঠকগুলোর ওপর নজর থাকবে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের, এমনটা মনে করছেন স্থানীয় কূটনীতিকেরা।
কূটনীতিকেরা অবশ্য বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার দিকটি বিবেচনায় রেখেই ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে।
বেইজিংয়ে সরকারপ্রধানের বৈঠকে কী হতে পারে, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল রোববার সাংবাদিকদের বলেন, এবারের সফরে কোনো চুক্তি সই হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন বিষয়ে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হবে।
স্থানীয় ঊর্ধ্বতন এক কূটনীতিক বলছেন, গত জুলাইয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিংয়ে শীর্ষ বৈঠক করে এসেছেন। এর এক বছরের কম সময়ের মধ্যে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক হচ্ছে। সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বেইজিং সফর করে এলেন। তাই এবারের বৈঠক থেকে ‘বোঝাপড়া গভীর করার বাইরে’ কোনো পক্ষই বেশি কিছু প্রত্যাশা করছে না।
এসব সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার এবারও চীনের কাছে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো, ঋণের সুদ কমানো, দেশটিতে রপ্তানি বাড়ানো ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দেশটির কাছ থেকে গঠনমূলক জোরালো ভূমিকার অনুরোধ রাখবে, এমনটা জানান ঢাকার কূটনীতিকেরা।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, জাপান, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পর চীন বাংলাদেশের ঋণের চতুর্থ একক বৃহত্তম উৎস। চীন ১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রায় ৯০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। এর প্রায় অর্ধেকের বেশি এসেছে প্রেসিডেন্ট সির ২০১৬ সালে ঢাকা সফরের পর। বর্তমানে দেশটি প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ঋণ ছাড় করে থাকে।
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের প্রস্তুতি এগিয়ে নিতে দুই দেশের কূটনীতিকেরা নিয়মিত পরামর্শমূলক বৈঠকে বসছেন। গতকাল ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন দেশটির রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। বৈঠকের পর রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বেইজিং সফরের সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘোষণা আসতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকীতে এই সফর একটি মাইলফলক হবে।
প্রধান উপদেষ্টা চার দিনের সফরে আগামী বুধবার চীনের পাঠানো একটি উড়োজাহাজে রওনা হবেন। পরদিন বৃহস্পতিবার তিনি হাইনান প্রদেশে বোয়াও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেবেন। আগামী শুক্রবার বেইজিংয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে তাঁর শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আগামী শনিবার পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দেবে। সেদিনই তাঁর দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
আসছেন মার্কিন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বেইজিং রওনা হওয়ার ৪৮ ঘণ্টারও কম সময় আগে আজ সোমবার রাতে ঢাকায় আসার কথা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জোয়েল বি ভোয়েলের। এক দিনের এই সফরে ইউনূস ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক আছে।
ইউনূসের চীন রওনা হওয়ার ঠিক আগে মার্কিন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তার ঢাকা আসার কী তাৎপর্য থাকতে পারে, এমন প্রশ্নে কূটনৈতিক বিশ্লেষক বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবীর আজকের পত্রিকাকে গতকাল বলেন, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডের অনেক কার্যক্রম আছে। মার্কিন কর্মকর্তার সফর সেই কার্যক্রমের অংশ হতে পারে। এর বাইরে চীন সফর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যতটা উদ্বেগ থাকবে, ভারতের উদ্বেগ থাকবে তার চেয়ে বেশি।
প্রধান উপদেষ্টার বেইজিং সফর সম্পর্কে হুমায়ুন কবীর বলেন, চীনারা বুদ্ধিমান। ওরা জানে, অধ্যাপক ইউনূসের সরকার অস্থায়ী সরকার। তাই তারা দীর্ঘ মেয়াদের কোনো ব্যবস্থায় এখন যাবে, এটা মনে হয় না।
ইউনূস-মোদি বৈঠকের সম্ভাবনা
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আগামী সপ্তাহেই শেষ দিকে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক যাবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও সাত দেশের এ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
মোদির সঙ্গে ইউনূসের বৈঠক চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিল্লিকে ঢাকা থেকে কূটনৈতিক পত্র দিয়েছে। পত্রটির জবাব এসেছে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গতকাল সাংবাদিকদের জানান, কোনো উত্তর আসেনি।
দুই দেশের কূটনীতিকেরা বলছেন, মোদির সঙ্গে ইউনূসের বৈঠকের বিষয়টি দিল্লি থেকে এখনো নাকচ করা হয়নি।
ইউনূসের সঙ্গে মোদির বৈঠকের সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে ভারতীয় একটি সরকারি সূত্র সেখানকার সংসদীয় প্যানেলকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের একটি জবাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জয়শঙ্কর বলেছেন, ইউনূসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির বৈঠক আয়োজনে বাংলাদেশের অনুরোধ বিবেচনা করা হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ‘পদত্যাগ করে’ শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ভারতে চলে যান। ব্যাংককের বৈঠকটি হলে এটাই হবে দুই দেশের মধ্যে হাসিনা-পরবর্তী সময়ে প্রথম শীর্ষ বৈঠক।
জয়শঙ্কর সংসদীয় প্যানেলকে বলেন, হাসিনা সরকারের পতনের আগেই বাংলাদেশে হাসিনাবিরোধী জনরোষ তৈরি হওয়ার ব্যাপারে ভারত অবগত ছিল। তাঁর দাবি, হাসিনার ওপর পর্যাপ্ত প্রভাব না থাকায় ‘পরামর্শ দেওয়া ছাড়া’ ভারতের তেমন কিছু করার পরিস্থিতি ছিল না।