বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য গত বছরের ২৭ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন আইন মন্ত্রণালয়ে। তবে প্রায় পাঁচ মাসেও তা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথক সচিবালয় না হওয়ায় বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সূত্র বলছে, বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
মাসদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করতে ১৯৯৭ সালে হাইকোর্ট ও ১৯৯৯ সালে আপিল বিভাগ রায় দেন। তবে রাজনৈতিক সরকার ওই রায় বাস্তবায়ন করেনি। ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচার বিভাগকে পৃথক করে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সারা দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে ২১ সেপ্টেম্বর অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মতো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব শিগগির আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
সুপ্রিম কোর্ট থেকে ২৭ অক্টোবর এ বিষয়ে ধারণাপত্র ও কিছু সংযুক্তিসহ প্রস্তাব পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। ওই ধারণাপত্রে বলা হয়, বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক সরকারের অনীহার কারণে বিচার বিভাগ পৃথক্করণ সম্ভব হয়নি। এ কারণে ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বর্তমান সময় হচ্ছে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের শ্রেষ্ঠ সময়। এ প্রচেষ্টার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা।
১৭ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে ইফতার মাহফিলে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন।
পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মোয়াজ্জম হোসাইন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট থেকে ধারণাপত্র পাঠানোর পর মন্ত্রণালয় থেকে আইনের খসড়া পাঠানো হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট ওই খসড়ার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। যত দূর জানি, বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।’
সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাবের বিষয়ে পদক্ষেপ জানতে চাইলে মন্তব্য করতে অপারগতা জানান আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ আবু তাহের।
১১৬ অনুচ্ছেদসংক্রান্ত রুল বিচারাধীন: পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে সংযুক্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অধস্তন আদালতের বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরসহ শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তা প্রযুক্ত করবেন।
এই অনুচ্ছেদকে বিচারকদের স্বাধীনতার জন্য বাধা মনে করা হয়। ১১৬ অনুচ্ছেদ চ্যালেঞ্জ করে ২৫ আগস্ট রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী। আবেদনে বলা হয়, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মূলত রাষ্ট্রপতির ওপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত থাকায় রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সরাসরি হস্তক্ষেপ দেখা যায়। এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করে।
ওই রিটের প্রাথমিক শুনানির পর ২৭ অক্টোবর রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং এ-সংক্রান্ত ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় কেন প্রতিষ্ঠা করা হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়। ওই রুলের শুনানি শেষপর্যায়ে রয়েছে।
রিটকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। ১১৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এ মৌলিক কাঠামো নষ্ট করা হয়েছে। নিম্ন আদালতের বিচারকেরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এর থেকে বের হতে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাষ্ট্রপক্ষ বারবার সময় নেওয়ায় ১১৬ অনুচ্ছেদের বিষয়টি হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
রুল নিষ্পত্তি না হওয়া এবং বারবার সময় চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘নো কমেন্ট’।
মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ বন্ধ চায় সংস্কার কমিশন: বিচারকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আইন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার সুপারিশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। কমিশনের মতে, মন্ত্রণালয়ের হাতে ক্ষমতা থাকার অর্থ দ্বৈত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বজায় থাকা। কাগজ-কলমে বিচারকদের স্বাধীনতার ঘোষণা থাকলেও এর সুবাদে অনেক ক্ষেত্রেই স্বাধীনভাবে বিচারিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা সম্ভব হয়।
জানতে চাইলে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন বলেন, কমিশনের সুপারিশ আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। এখন বিচার বিভাগ নামমাত্র স্বাধীন, সবকিছু আসে মন্ত্রণালয় থেকে। পৃথক সচিবালয় করে বাজেট, বদলি-পদোন্নতিসহ সম্পূর্ণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টকে দিতে হবে।