Homeজাতীয়বহুমুখী পদক্ষেপ সরকারের, চিঠি যাচ্ছে ট্রাম্পের কাছে

বহুমুখী পদক্ষেপ সরকারের, চিঠি যাচ্ছে ট্রাম্পের কাছে


যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপিত বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কভার লাঘবে বহুমুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর অংশ হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের একটি বিশেষ বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য জানিয়েছেন।

গত বুধবার মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসার পর পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয় ঠিক করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর এ নির্দেশনা পেয়ে গত চার দিনের চেষ্টায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মহলের যৌথ অংশগ্রহণে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠক থেকে পাওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় সরকার।

প্রেস সচিব আজ জানান, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দুটি চিঠি দেবে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চিঠি দুটি পাঠানো হবে। দুটি চিঠির একটি পাঠাবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠিটি দেবেন। অন্য চিঠিটি বাণিজ্য উপদেষ্টা বশিরউদ্দীন পাঠাবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরে (ইউএসটিআর)। এই চিঠিতে বাংলাদেশ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি সহজ করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে ও নেবে এবং বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সহজ করার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তার কৌশলগুলো কী হবে, তা তুলে ধরা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত

আজ অর্থ মন্ত্রণালয়ে সোয়া ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা ইউএসএর সঙ্গে বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ লক্ষ্যে দেশটি থেকে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় পণ্য এবং সেবা—উভয় ধরনের আমদানিই বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে বাংলাদেশের আরোপ করা শুল্কহার যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে কমিয়ে আনা হবে। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বিদ্যমান ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ বাধাগুলোও দূর করার দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আশা করছি, এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।’

বৈঠকে অন্যদের মধ্যে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ড. খলিলুর রহমান, বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, অর্থসচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, বাণিজ্যসচিব মো. মাহবুবুর রহমান, বিনিয়োগ বোর্ডের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক, ফারুক হাসান, ব্যবসায়ী তপন চৌধুরী, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বিকেএমইএর সভাপতি মো. হাতেমসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এ নিয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, মার্কিন শুল্কনীতি ইস্যুতে দেশটির বাজারে যাতে কোনোভাবেই বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগী সক্ষমতা না কমে, সরকারি নীতি-পদক্ষেপে সেদিকে জোরালো নজর থাকবে।

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানান, ‘ধারাবাহিক বৈঠকের পর সবার সুপারিশ পর্যালোচনা করে আমরা সংকট উত্তরণের একটা সহায়ক পদক্ষেপে পৌঁছেছি। আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি, যা আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সবার কাছে স্পষ্ট হবে।’

খলিলুর রহমান বলেন, ‘মার্কিন নতুন শুল্কনীতি ইস্যুটির যথাসম্ভব একটি সন্তোষজনক সমাধানে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। এর জন্য করণীয় সবকিছুই করা হবে।’

বৈঠক শেষে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, সরকারের উদ্যোগে তাঁরা সন্তুষ্ট। সরকার যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির পরিপ্রেক্ষিতে যে কর্মকৌশল নিচ্ছে, তাতে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে বলে আশা করছেন তাঁরা। আজকের বৈঠকের আলোচনায় যার একটি পথনির্দেশনা পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা, যেটি ব্যবসায়ীদের জন্য সুখবর।

সরকারকে ৬ পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ

এদিকে গতকাল সকালে বাণিজ্যসচিব মো. মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে আন্তমন্ত্রণালয়ের আরেকটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রপ্তানিকারক, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠক থেকে পাওয়া সুপারিশের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন শুল্কনীতি কার্যকরে ন্যূনতম ৩ থেকে ৬ মাস অতিরিক্ত সময় চাওয়া।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সরকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউএসটিআরকে যে দুটি চিঠি পাঠাতে যাচ্ছে, সেখানে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উঠে আসবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানির গতি বাড়াতে বাংলাদেশে মার্কিন রপ্তানিকারকদের জন্য দ্রুত ওয়্যারহাউস প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখারও সুপারিশ করা হয় বৈঠকে। বাকি পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে তুলাসহ অন্যান্য পণ্য ও সেবার আমদানি বৃদ্ধি, বাংলাদেশে বিদ্যমান শুল্কহার যৌক্তিকীকরণ, মার্কিন প্রশাসনে দ্রুত চিঠি চালাচালি শুরু করা ও টেলিসংলাপ অব্যাবহত রাখা এবং টিকফা ফোরামে বাংলাদেশের জোরালো আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।

বৈঠকে অংশ নেওয়া ট্রেড বিশেষজ্ঞ ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, মার্কিন তুলা আমদানিতে ওয়্যারহাউস নির্মাণের সিদ্ধান্ত পুরোনো হলেও এবার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দ্রুততা আনা হচ্ছে। তিনি সতর্ক করেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে, তাহলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট রপ্তানি হুমকির মুখে পড়বে। মার্কিন বাজারে বছরে ৮০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি হয়, সেখানে ১০-২৫ শতাংশ কমতি বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াতে পারে। পাশাপাশি যদি চীন তাদের মার্কিন রপ্তানি কমায়, তবে তারা ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশ বাড়াতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলার আমদানি তিন থেকে চার গুণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে, যা বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ভূমিকা রাখবে। এই উদ্যোগ সফল করতে হলে দ্রুত অবকাঠামো প্রস্তুত করা জরুরি।

নীতিগত দিক থেকে দ্রুত পদক্ষেপের আহ্বান জানান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, ‘সরকারকে দুই দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চিঠি পাঠাতে বলেছি। সময়ক্ষেপণ না করে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার।’

এদিকে শুল্ক ব্যবস্থাপনার দিকটি সামনে রেখে এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, এমন পণ্যের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে, যেগুলো শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকেই আমদানি হয় এবং শুল্ক কমালে রাজস্ব ঘাটতি হবে না। তবে তাঁরা সতর্ক করে বলেন, একতরফাভাবে শুল্কছাড় দিলে অন্যান্য দেশও একই দাবি তুলতে পারে। এ জন্য হিসাব-নিকাশ করে কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে।

মাসরুর রিয়াজ বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেন, ‘শুধু অনুমানভিত্তিক ছাড় দিলে হবে না, যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা কী—তা জেনে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একতরফা ছাড় দিলে তা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না।’

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের বৈঠক

ডোনাল্ড ট্রাম্প আরোপিত শুল্ক বিষয়ে আলোচনার জন্য গতকাল মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সরকারের শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারকেরা। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, যে মানদণ্ডে বাংলাদেশের ওপর মার্কিন নতুন শুল্কনীতি আরোপ করা হয়েছে, তা সঠিক ও নৈতিক হয়নি। কারণ, বাংলাদেশে মার্কিন পণ্যের শুল্কহার গড়ে ৫ শতাংশের বেশি নয়। বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

গুলশান ২-এ মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের বাসভবনে ‘ব্রেকফাস্ট অন ট্রেড ব্যারিয়ার্স’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, শিল্প উপদেষ্টা মো. আদিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ড. খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সভায় দুটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন উপদেষ্টারা। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং কিছু মার্কিন পণ্যে শুল্ক কমানো, ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ সহজ করা। একই সঙ্গে মার্কিন শুল্কনীতি ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান ট্রাম্প প্রশাসনকে অবহিত করতেও অনুরোধ জানানো হয়।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত