প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বাংলাদেশ কী বলতে পারে—তা নিয়ে রবিবার (৯ মার্চ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিবের সভাপতিত্বে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, পানি, বৈদেশিক ঋণ, কৃষি, কানেক্টিভিটি, জ্বালানিসহ বিভিন্ন সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে কোন বিষয়গুলো বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হবে, সে বিষয়ে কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘চীন সম্পর্কিত সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয় আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে তুলে ধরেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রকল্পের তালিকাও রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার অফিসের সঙ্গে সমন্বয় করে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ কী বলবে, সেটি ঠিক করা হবে।’
সম্ভাব্য সফরসূচি
চীনের হাইনান প্রদেশে বোয়াও ফোরাম কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য আগামী ২৬ মার্চ দেশটির উদ্দেশে রওনা দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। পরের দিন ২৭ মার্চ সম্মেলনের উদ্বোধনী প্লেনারি সেশনে বক্তব্য দেবেন তিনি। এছাড়া চীনের স্টেট কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রিমিয়ার দিং ঝুঝিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে মুহাম্মদ ইউনূসের।
২৮ মার্চ বেইজিংয়ের গ্রেট হলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের দিন ধার্য রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার। একই দিনে হুয়াই কোম্পানির উচ্চ-প্রযুক্তিসম্পন্ন এন্টারপ্রাইজ পরিদর্শন করবেন তিনি। চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করবে।
২৯ মার্চ চীনের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় পিকিং ইউনিভার্সিটি তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবে এবং সেখানে তিনি বক্তব্য রাখবেন। এরপর সেদিনই বেইজিং থেকে চীনের একটি বিমানে ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার।
স্বাস্থ্য বিষয়ক সহযোগিতা
যেসব বাংলাদেশি বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করেন, তার একটি বড় অংশ ভারতে যান। বর্তমানে ভারতে ভিসা জটিলতার কারণে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা বেকায়দায় পড়ছেন। এজন্য কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতাল বাংলাদেশিদের জন্য নির্ধারিত করার বিষয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে চীনকে অনুরোধ করা হয়েছে এবং সেখানে রোগীরা যেন সহায়ক পরিবেশে চিকিৎসা নিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানানো হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বাংলাদেশি রোগীদের প্রথম ব্যাচ সোমবার (১০ মার্চ) চীনের উদ্দেশে রওনা দেবে।
ঢাকার পক্ষ থেকে বেইজিংকে ভিন্ন আরেকটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো বাংলাদেশে একটি উন্নতমানের হাসপাতাল তৈরি করে দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ নতুন উদ্যোগ অনুযায়ী একদিকে বাংলাদেশি রোগীরা চিকিৎসার জন্য চীনে যাবেন, অপরদিকে বাংলাদেশে তাদের সহায়তায় একটি বিশ্বমানের হাসপাতাল তৈরি হবে।
এ বিষয়ে সরকারের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশিরা চীনে চিকিৎসা করাতে যাবেন কিনা, সেটি নির্ভর করবে রোগীদের অনুভূতির ওপর। প্রথম ব্যাচে যারা যাবেন, তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতামতের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করতে পারে।’
হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়ে এই কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন। এ বিষয়ে তারা উদ্যোগ নেবে।
বাণিজ্যিক সহযোগিতা
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। দেশটির সঙ্গে বিনিয়োগ, কৃষি, কানেক্টিভিটি, পানি, জ্বালানি, প্রকল্প সহায়তা, প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সহযোগিতা রয়েছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চীন থেকে আমরা যে ঋণ নেই, সেটির সুদের হার তুলনামূলক বেশি এবং পরিশোধের মেয়াদও কম। আমরা এর আগেও বিষয়টি নিয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা করেছি।’
চীনে যেসব সানসেট ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে, সেগুলোর একটি অংশ যদি বাংলাদেশে স্থাপিত হয়, তবে উভয় দেশ লাভবান হতে পারে। এতে একদিকে যেমন বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অপরদিকে চীন এখানে ব্যবসা করে লাভবান হতে পারবে বলে তিনি জানান।
কৃষির সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নতুন প্রজন্ম কৃষিকাজে তেমন আগ্রহী নয়। ফলে অল্পসংখ্যক লোক দিয়ে বেশি উৎপাদনের জন্য যান্ত্রিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনও বিকল্প নেই। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহারের বিষয়ে চীন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাদের কাছ থেকে আমরা এ বিষয়ে সহায়তা নিতে পারি।’
চিটাগাং-কুনমিং সরাসরি বিমান চলাচলের বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে এবং এটি চালু করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে বলে তিনি জানান।
রাজনৈতিক সংযোগ
চীন বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তি এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে এক নম্বর শক্তি হওয়ার। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে যে একটি অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করবে, সেটিই স্বাভাবিক। বাংলাদেশকে এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও ভারসাম্য রক্ষা করে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বৃহৎ শক্তিগুলোর মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখে জাতীয় স্বার্থ উদ্ধার করতে হবে।
এ বিষয়ে আরেকজন সরকারের কর্মকর্তা বলেন, ‘চীনের প্রেসিডেন্টের মোট চারটি বৈশ্বিক উদ্যোগের মধ্যে একটিতে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল থেকে যুক্ত।’
উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৩ সালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ শুরু করেন। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সময়ে এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। শি জিনপিং সম্প্রতি আরও তিনটি উদ্যোগ নিয়েছেন– গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ এবং গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভ। এর মধ্যে ২০২২ সালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ঢাকা সফরের সময়ে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রস্তাবটি আমাদের বিবেচনাধীন রয়েছে। আমরা এর বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করছি।’