রেকর্ড কাটছাঁট করা হয়েছে উন্নয়ন বাজেট। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে বাদ গেল ৪৯ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ। গত ৫০ বছরের মধ্যে এত বেশি বরাদ্দ কমাতে হয়নি কখনও। এমনকি করোনা মহামারির সময়ও কমাতে হয়েছে এর চেয়ে অনেক কম। এ অবস্থার নেপথ্যে রয়েছে প্রধানত পাঁচটি কারণ।
এগুলো হলো — আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড় না করা, অন্তর্বর্তী সরকারের কড়াকড়ি, অদক্ষতায় সময় মতো কাজ করতে না পারা, পুরানো সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক।
সোমবার (৩ মার্চ) এডিপি অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ও এনইসি চেয়ারপার্সন ড. মোহাম্মদ ইউনূস। বৈঠক শেষে ব্রিফিং করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।
বিফ্রিং এ ড.ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, এ অর্থবছর আমরা চাইছি এডিপি ছোট থাকুক। কেননা অনেক বড় বরাদ্দ দিয়ে ব্যয় করতে না পারলে সেটি ভালো দেখায় না। সেই সঙ্গে এবার বাজেট ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আসছে। আগে থেকেই রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় ঘাটতি বেশি রেখে বরাদ্দ দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, সব প্রকল্প ইএমআইএস সফটওয়্যারে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে থাকলে কোনটার কী অবস্থা, তার আপডেট জানা যাবে। যদি কোনও প্রকল্পের আপডেট না থাকে তাহলে অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থছাড় করবে না। এছাড়া প্রকল্প গ্রহণের পরিবেশের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। আগে কীভাবে পরিবেশ অধিদফতরের না কে হ্যাঁ করা হতো, তা আমরা সবাই জানি। এমনটি বাড়ি করতেও পরিবেশ অধিদফতরের ছাড় পত্র নিতে অনিয়ম হয়েছে। সেগুলো এখন কঠোরভাবে দেখা হবে।
ব্রিফিং এ জানানো হয়, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে মোট বরাদ্দ রয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা (স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ ছাড়া)। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে এক লাখ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত এডিপিতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুই লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। ফলে বরাদ্দ কাটছাঁট হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ দেওয়া হবে এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ৮১ হাজার কোটি টাকা।
মূল এডিপিতে চলমান প্রকল্প ছিল এক হাজার ৩৫২টি। এখন সংশোধিত এডিপিতে বেড়ে প্রকল্প সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৩৭টি। এছাড়া অননুমোদিত নতুন প্রকল্প কমে হয়েছে ৭৭০টি। যা মূল এডিপিতে ছিল ৯১০টি।
সংশোধিত এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া পাঁচটি খাত হলো— পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৪৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৩১ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা, শিক্ষায় ২০ হাজার ৩৪৯ হাজার কোটি, গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলীতে ১৯ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৬ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা।
মন্ত্রণালয় ভিত্তিক সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩৬ হাজার ১৫৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ বিভাগ ২১ হাজার ৪৭৫ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ১৮ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা।
ব্রিফিং এ জানানো হয়েছে, চলতি অর্থবছরে ৭ মাসে (জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত) এডিপির বাস্তবায়ন হয়েছে ২১ দশমিক ৫২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল ২৭ দশমিক ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ৭ মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করতে পেরেছে ৫৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে খরচ হয়েছিল ৭৪ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) জানায়, গত অর্থবছরর এডিপিতে মোট বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে এসে ২০ হাজার ২৮২ কোটি টাকা কাটছাঁট করে মোট বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয় দুই লাখ ৫৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। এ অর্থবছর শেষে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছিল ২ লাখ ৫ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দ কমিয়ে যা দেওয়া হয়েছিল তার ৮০ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ৫৬ হাজার তিন কোটি টাকা। অর্থবছরের মাঝ পথে এসে ১৯ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা বাদ দিয়ে বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল এরও কম দুই লাখ এক হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ বরাদ্দের ৮৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে মূল বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এরপর ১৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা বাদ দিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ দেওয়া হয় দুই লাখ ১০ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল দুই লাখ তিন হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা, বা ৯২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল এডিপি বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা কাটছাঁট সংশোধিত বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল এক লাখ ৭১ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৮২ দশমিক ১১ শতাংশ।