নাড়ির টানে ঈদ করতে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে বাড়ির পানে যাচ্ছে মানুষ। গতকাল শনিবার পর্যন্ত এবারের ঈদযাত্রায় তেমন কোনো ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি মানুষকে। সড়ক, রেলপথ ও নৌপথে স্বস্তির যাত্রা ঈদ উৎসবে বাড়িমুখী মানুষের জন্য বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে।
আজ রোববার চাঁদ দেখা গেলে কাল সোমবার ঈদ। তবে ঈদযাত্রায় গতকালও বাস, ট্রেন ও লঞ্চে অতিরিক্ত চাপ দেখা যায়নি। যানবাহনের চাপে বিভিন্ন মহাসড়কের কোথাও কোথাও ধীরগতি দেখা গেলেও তীব্র যানজটে পড়তে হয়নি মানুষকে। যানজটে আটকে সময় নষ্ট না হওয়ায় বাস ছেড়েছে প্রায় সময়মতো। বেশির ভাগ ট্রেনই নির্ধারিত সময়ে ছেড়েছে। স্টেশনে গতকালও জাল টিকিট ধরা পড়েছে।
রেলপথে ঈদযাত্রার ষষ্ঠ দিনে গতকাল কমলাপুর থেকে প্রায় ৭০টি ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেছে। এর মধ্যে রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ৪৫ মিনিট এবং সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ১ ঘণ্টা বিলম্বে স্টেশন ছেড়েছে। বাকিগুলো প্রায় নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে যাওয়ায় এবার ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়নি।
কমলাপুরে ঢাকা রেলস্টেশন ঘুরে দেখা যায়, স্টেশনে বাড়িমুখী যাত্রীদের ভিড়। কেউ সপরিবার, কেউবা একা বাড়ি যাচ্ছেন প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। তাঁদের অনেকে গতকাল অফিস থেকে সোজা চলে গেছেন স্টেশনে। বেশির ভাগ ট্রেনে যাত্রীদের ভিড় দেখা গেছে। আসনবিহীন টিকিটের যাত্রীদের দাঁড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। কর্তৃপক্ষের নিষেধ থাকলেও সকালে একতা এক্সপ্রেস ট্রেনের ছাদে অনেক যাত্রী উঠেছেন।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করেও কাউকে ছাদ থেকে নামাতে পারেনি। সকাল সোয়া ১০টায় ছাদে যাত্রী নিয়েই কমলাপুর ছেড়েছে ট্রেনটি।
ট্রেনের ছাদে ওঠা যাত্রী মো. জমশেদ আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘স্ট্যান্ডিং টিকিট কেটেছি। কিন্তু ট্রেনের ভেতরে দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। দীর্ঘ পথ ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। ছাদে ভ্রমণ অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বসে একটু আরামে যেতে ছাদে উঠেছি।’
ঠাকুরগাঁওগামী যাত্রী রোকন আহমেদ বলেন, তিনি নারায়ণগঞ্জে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। গতকাল থেকে ছুটি হয়েছে। ট্রেনের স্ট্যান্ডিং টিকিট পেয়েছেন। ভেতরে ভিড়। তাই ছাদে উঠেছেন। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নামানোর চেষ্টা করছেন; কিন্তু তাঁরা নামবেন না।
কমলাপুর রেলস্টেশনের এক কর্মচারী জানান, রাতের ট্রেনগুলোতে ছাদে বেশি যাত্রী যাচ্ছেন। উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ ট্রেনেই ছাদে যাত্রী গেছে। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের ছাদ থেকে চেষ্টা করেও যাত্রীদের নামানো যায়নি।
কমলাপুর রেলস্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি টিকিট ছাড়া কাউকে স্টেশনে ঢুকতে না দিতে। অনেকে স্ট্যান্ডিং টিকিট কেটে ট্রেনের ছাদে উঠছেন। আমরা তাঁদের নামানোর চেষ্টাও করছি। তবে সবাই বাড়ি যাবেন বলে মানবিক দিক থেকে জোরও করা যাচ্ছে না। সাধ্যমতো চেষ্টা করছি নামানোর।’
ধারণা করা হচ্ছে, আজ সকালের দিকে যাত্রীর চাপ থাকলেও বিকেল এবং রাতের ট্রেনগুলোতে খুব একটা ভিড় হবে না। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে নির্ভর করবে সোমবারের ট্রেন চলাচল।
বাস টার্মিনালে যাত্রীদের চাপ নেই
রাজধানীর তিনটি আন্তজেলা বাস টার্মিনাল, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনালে সকাল থেকে যাত্রীদের তেমন ভিড় ছিল না। অগ্রিম টিকিট কাটা যাত্রীরা নির্ধারিত সময়েই বাসে উঠে রাজধানী ছেড়েছেন। বলতে গেলে সড়কপথের বেশির ভাগ যাত্রী নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। তবে বাসে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী।
আমিনবাজার সেতু এলাকায় দেখা যায়, দূরপাল্লার বাসের পাশাপাশি মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ির ভিড়। অনেকে খোলা ট্রাক, পিকআপ ভ্যানে ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে রওনা দিচ্ছেন।
নির্মাণশ্রমিক মো. জুয়েল রানা গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাচ্ছেন ট্রাকে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসের ভাড়া অনেক। তাই আমরা শ্রমিকেরা দল বেঁধে ট্রাকে করে জনপ্রতি ৩০০ টাকা ভাড়ায় বাড়ি যাচ্ছি।’
ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রুটের বাস এসআর পরিবহনের কাউন্টারের কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম বলেন, এবার যাত্রীর চাপ নেই। সড়কের পরিস্থিতিও বেশ ভালো। ধাপে ধাপে যাওয়ার কারণে প্রতিবছরের মতো এবার এক-দুই দিনে মূল চাপ পড়েনি। তাই যাত্রায় স্বস্তি।
গাবতলী বাস টার্মিনালে রুবাইয়া সুলতানা বলেন, ৬ বছরে এবার প্রথম এত শান্তিতে যাচ্ছেন।
কেউ কেউ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন। গাবতলী থেকে ঝিনাইদহগামী দুই বন্ধু সজীব ও তিতাস জানান, ৫৫০ টাকার টিকিট ৭৫০ টাকায় কিনতে হয়েছে। সাতক্ষীরাগামী একটি বাসের টিকিট এক যাত্রী কিনলেন ৯২০ টাকায়, যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি।
অতিরিক্ত ভাড়া ঠেকাতে প্রতিদিন বাস টার্মিনালগুলোতে ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তর এবং বিআরটিএ নজরদারি করছে। বাড়তি ভাড়া নিলে জরিমানা করছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গাবতলী বাস টার্মিনালে যান। তিনি যাত্রীদের বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়ার বেশি কেউ চাইলে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে জানাতে বলেন। তিনি বলেন, দু-একটি ছোট ঘটনা ছাড়া অতিরিক্ত ভাড়া আদায় তাঁদের নজরে আসেনি। মালিকপক্ষকে প্রত্যেক চালককে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছে।
মহাখালী বাস টার্মিনালেও যাত্রীর চাপ দেখা যায়নি। টিকিট নিয়েও ভোগান্তি নেই।
ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটের লাবিবা ক্ল্যাসিক বাসের কাউন্টার ম্যানেজার আলী হোসেন বলেন, যাত্রীর চাপ খুব নেই। লম্বা ছুটির কারণে অনেকে আগেই আস্তে আস্তে চলে গেছেন। প্রায় নির্দিষ্ট সময়েই বাস ছাড়া হচ্ছে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের ইউনাইটেড এক্সপ্রেসের কাউন্টারের কর্মীরা জানান, গত কয়েক দিনের তুলনায় যাত্রীর চাপ তুলনামূলক কম। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে কয়েক জায়গায় যানজট থাকায় বাসগুলো আসতে দেরি হচ্ছে। এতে নির্দিষ্ট সময়ে বাস ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যান্য বছরের মতো এবার মাইক্রোবাসে যাত্রীর চাপ নেই। মাইক্রোবাসের চালক মো. সিরাজ বলেন, যাত্রীরা সবাই বাসেই যেতে পারছেন বলে এবার তাঁদের ট্রিপ একদমই নেই।
মহাসড়কে নেই ভোগান্তির যানজট
ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কে গতকাল যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ থাকলেও যানজট ছিল না। নির্বিঘ্ন যাত্রায় খুশি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা। দেশের অন্যান্য মহাসড়কেও ছিল স্বস্তির যাত্রা।
সব পোশাক কারখানায় গতকাল ঈদের ছুটি হওয়ায় গাজীপুর ও চন্দ্রা এলাকায় যানবাহনের দীর্ঘ সারি ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারিও দীর্ঘ হয়। তবে চন্দ্রায় উত্তরাঞ্চলগামী সড়ক যানজটমুক্ত রাখতে একমুখী চলাচলের ব্যবস্থা করা হয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক তৎপর ছিল।
গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ হাজার ৩৩৫টি যান যমুনা সেতু পারাপার হয়েছে। এতে টোল আদায় হয়েছে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৯০০ টাকা। এবার ঈদের ছুটি শুরুর পর এটি এই সেতুতে সর্বোচ্চ যান পারাপার ও সর্বোচ্চ টোল আদায়।
একই সময়ে পদ্মা সেতু পারাপার হয় ৩৯ হাজার ৬৩৭টি যান। টোল আদায় হয় ৪ কোটি ২৫ লাখ ৪১ হাজার ৩০০ টাকা। মোটরসাইকেল পারাপার হয় ৯ হাজার ৮৫২টি।
শ্যামলী এন আর ট্রাভেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর ঘোষ রাকেশ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়লেও গতকাল পর্যন্ত কোথাও যানজট হয়নি। এখন পর্যন্ত এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক। বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।’
শেষ সময়ে ভিড় বেড়েছে লঞ্চে
সদরঘাট ঘুরে দেখা যায়, লঞ্চ টার্মিনাল ও পন্টুনে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। লঞ্চগুলো ছেড়ে গেছে যাত্রীবোঝাই হয়ে। ডেক ও কেবিনে পরিপূর্ণ যাত্রী থাকায় সন্তুষ্ট লঞ্চমালিক ও কর্মচারীরা।
সকাল থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের লঞ্চ ছেড়ে গেছে যাত্রী নিয়ে। তবে অনেক যাত্রী অভিযোগ করেন, যাত্রী পূর্ণ হওয়ার পরও নির্ধারিত সময়ে লঞ্চ ছাড়ছে না। গরমে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর ছাড়ছে লঞ্চ।
বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক মোবারক হোসেন বলেন, গত দুদিনে অনেক যাত্রী ঢাকা ছাড়ায় উপচে পড়া ভিড় হওয়ার আশঙ্কা নেই। নির্ধারিত সময়ে লঞ্চ না ছাড়লে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।