দেশের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা জোরদারে ‘বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্স’ (বিএএসএফ) নামে একটি বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা হবে ১০,৬৩২ জন। প্রস্তাব অনুযায়ী, এই জনবলের ৭০ শতাংশ নেওয়া হবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) নতুন এই বাহিনী গঠনসংক্রান্ত প্রস্তাব বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এ নিয়ে বেবিচকের ভেতরেই অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। প্রস্তাবটি বাতিল এবং বেবিচকের এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক) বিভাগের স্বার্থ সংরক্ষণের দাবিতে বেবিচকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, বেবিচককে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে।
বিক্ষোভের পর বেবিচক বলেছে, এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি।
সূত্র জানায়, বিএএসএফ গঠনের প্রস্তাব অনুযায়ী, দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোতে এই বাহিনী
দায়িত্ব পালন করবে। এটি থাকবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বাহিনীটি পরিচালিত হবে বেবিচকের চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে। নতুন এই বাহিনী গঠনের প্রাথমিক বাজেট ধরা হয়েছে ৩৯৭ কোটি ২ লাখ টাকা।
দেশের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তার জন্য বর্তমানে এভসেক, এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা নিয়োজিত রয়েছেন। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনার জন্য আরও ৩ হাজার ৪৯২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ মোট ৫ হাজার ১১২ জনকে নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।
বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া সম্প্রতি জানান, উন্নত বিশ্বের বিমানবন্দরগুলোর মতো বাংলাদেশেও একটি বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী থাকা প্রয়োজন। এই বাহিনী আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবে এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে কাজ করবে।
সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিএএসএফ গঠনসংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত এই বাহিনীর মোট জনবল হবে ১০ হাজার ৬৩২ জন। তাঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশ সামরিক ও ৩০ শতাংশ জনবল হবে অসামরিক। এই বাহিনীর প্রধানের পদ হবে মহাপরিচালক। যিনি হবেন বিমানবাহিনীর ‘এয়ার ভাইস মার্শাল’ বা ‘এয়ার কমোডর’ পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তাঁর অধীনে চারজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার) এবং তিনজন পরিচালক (উইং কমান্ডার পদমর্যাদার) থাকবেন।
প্রস্তাব অনুযায়ী, নতুন বাহিনীর মোট জনবলের মধ্যে ৫ হাজার ১৬৭ জন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, ৯৫৯ জন করে সিলেট এম এ জি ওসমানী, চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও কক্সবাজার বিমানবন্দরে মোট ২ হাজার ৮৭৭ জন নিযুক্ত হবেন। অভ্যন্তরীণ চারটি বিমানবন্দর—যশোর, রাজশাহী, বরিশাল ও সৈয়দপুরে ৫৬০ জন করে মোট ২ হাজার ২৪০ জন সদস্যকে দেওয়া হবে। এই জনবল নিয়োগ সম্পন্ন হবে তিন ধাপে। প্রথম ধাপে ৩ হাজার ৮৯৪ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৩ হাজার ৪০৭ এবং তৃতীয় ধাপে ৩ হাজার ৩৩১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রস্তাবে অসামরিক কতজন এবং বিমানবাহিনীর কতজন নিয়োগ পাবেন, তা উল্লেখ করা হয়েছে।
বিএএসএফ গঠনের প্রস্তাব পাঠানোর খবরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে বেবিচকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। তাঁরা বিএএসএফ গঠনের প্রস্তাব বাতিল ও বেবিচকের এভসেক বিভাগের স্বার্থ সংরক্ষণসহ ছয় দফা দাবিতে ১৭ মার্চ প্রধান কার্যালয় প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করেন। তাঁরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের এক পাশ বন্ধ রাখলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
সভায় কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে বেবিচকের অধীনে এভসেক বিভাগ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। তাই বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য নতুন একটি বাহিনী গঠনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটি এভসেক বিভাগের অস্তিত্বের ওপর সরাসরি হুমকি তৈরি করবে। তাঁরা বেবিচক চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিও জানান।
বেবিচকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সারা বিশ্বে সিভিল এভিয়েশন সংস্থাগুলো বেসামরিক কর্মীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশেও এই রীতি বজায় রাখা উচিত।
বেবিচকের কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরামের নেতারা বলছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্স গঠনের নামে যা করা হচ্ছে, তাতে সিভিল কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে এবং এভিয়েশন সেক্টরে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। স্বাধীন সিভিল সংস্থা হিসেবে বেবিচকের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভের পর বেবিচকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মাদ কাউছার মাহমুদের স্বাক্ষর করা বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সম্প্রতি একটি নির্দিষ্ট সংস্থার নামে ভিত্তিহীন তথ্য প্রকাশ করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে হলে তা বোর্ড মিটিং ও দাপ্তরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পর্যালোচনা করা হয়। এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা এবং যাত্রীসেবা উন্নত করতে বেবিচক নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মতামত গ্রহণ ও যাচাই-বাছাই করে। সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সহযোগিতায় একটি আধুনিক, নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য এভিয়েশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বেবিচক নিরলসভাবে কাজ করবে।
বেবিচকের সূত্র বলছে, বিভিন্ন সময়ে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে কার্যকর ফল আসছে না। এ কারণে নিরাপত্তাব্যবস্থা নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় বিমানবন্দরগুলোর স্ক্যানিং তল্লাশির সক্ষমতা বাড়ানো হবে; পাশাপাশি ইডিএস, ডুয়েল ভিউ এক্স-রে স্ক্যানিং মেশিন, আন্ডার ভেহিকল স্ক্যানিং মেশিন, এক্সপ্লোসিভ ট্রেস ডিটেক্টর (ইডিটি), লিকুইড এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম এবং ডাবল ক্যাব পিকআপ ইটিভি কনসুমাবেলস ফর এক্সপ্লোসিভ ট্রান্স ডিটেক্টর মেশিন সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিশ্বের সব দেশের বাণিজ্যিক বিমানবন্দরের মতো বেসামরিক ক্ষেত্রগুলো বেসামরিক প্রশাসন দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিগত সময়ে এটি হয়েছে। বেবিচকের তত্ত্বাবধানে এপিবিএন, বিজিবি, আনসারসহ সরকারের অন্যান্য সিভিল প্রশাসনের সদস্যরাই বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা দিচ্ছেন। সেখানে হঠাৎ কী কারণে বিমানবাহিনীকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করা হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, এমনিতে বেবিচকের ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নেওয়া নতুন এই চিন্তা হিতে বিপরীত হতে পারে।