আগেই ধারণা করা হয়েছিল যে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের ধাক্কা আসবে। শপথ গ্রহণের পরপরই জেনেভাভিত্তিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ফলে সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা স্বল্প বা মধ্যমেয়াদের জন্য কিছুটা হলেও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেলো। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই ধাক্কা অনুভূত হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেনেভায় জাতিসংঘের সংস্থাগুলোতে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি মো. সুফিউর রহমান বলেন, ‘সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কিছুটা হলেও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। কারণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে। ওই সহযোগিতার একটি বড় অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।’
তিনি বলেন, ‘একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হবে। কোভিড অতিমারির সময়ে আগাম অর্থ দেওয়ার পরেও নিজস্ব সমস্যার কারণে বাংলাদেশকে টিকা দিতে পারেনি ভারত। নগদ অর্থে চীনের কাছ থেকে টিকা সংগ্রহ করতে হয়েছে। কিন্তু ওই সময়ে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি টিকা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেটি তারা বিনা অর্থে দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্সের মাধ্যমে।’
মহামারি বিদ্যা
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ভাইরাসজনিত অতিমারি বা মহামারির প্রকোপ দেখা দেয়।
মো. সুফিউর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের ভাইরাস পাওয়া গেলে সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুটি বৃহৎ সংস্থায় পরীক্ষা করা হয়। এর একটি ফ্রান্সের পাস্তর ইনস্টিটিউট এবং অপরটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমঝোতা আছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে স্যাম্পল পাঠানোর পরে এসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানেও সেগুলো পরীক্ষা হয়ে থাকে।’
এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বের হয়ে যাবে, তখন যেকোনও ধরনের পরীক্ষা করার জন্য সিডিসির সঙ্গে বাংলাদেশকে সরাসরি যোগাযোগ করতে হবে এবং এর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বহুল পরীক্ষিত বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার বদলে দ্বিপক্ষীয় মেকানিজম প্রতিষ্ঠা করতে হবে বলে তিনি জানান।
মহামারি মোকাবিলা নিয়ে আলোচনা
কোভিড পৃথিবীর প্রথম মহামারি নয় এবং একইসঙ্গে শেষও নয়। নতুন কোনও মহামারি দেখা দিলে সারা বিশ্ব কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আলোচনা চলছে— একটি প্যান্ডেমিক ট্রিটি করার জন্য।
মো. সুফিউর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বের হয়ে গেলে ওই মহামারি মোকাবিলা নিয়ে চুক্তি সম্পাদনের আলোচনা গতি হারাবে এবং এর বাস্তবায়ন করা মুশকিল হবে।’
বহুপাক্ষিক ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা একজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের কারণে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হোঁচট খাবে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বের হয়ে যেতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বের হয়ে গেলেও পর্যবেক্ষক হিসেবে অবদান রাখতে পারে।’
বাংলাদেশের জন্য করণীয়
অনেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ বা ‘আগাম কিছু বলা যায় না’ – এমন ধরনের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু কিছু বিষয়ে ট্রাম্পের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা করা প্রয়োজন।
মো. সুফিউর রহমান বলেন, ‘ট্রাম্পের বিষয়ে কয়েকটি জিনিস অত্যন্ত পরিষ্কার। একটি হচ্ছে ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প লেনদেনভিত্তিক কূটনীতির ওপর নির্ভর করবেন। দ্বিতীয় হচ্ছে, বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার ওপর ট্রাম্পের আস্থা সীমিত বা নেই।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। এর কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা অন্য শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সবকিছু আলোচনা করলে, ছোট দেশগুলোর পক্ষে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করা বা সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বহুপাক্ষিকতাবিরোধী মনোভাব আন্তর্জাতিক পর্যায়ের স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দিতে পারে বলে তিনি জানান।
একজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, ’বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যে কাজগুলো করতো, সেগুলো তারা হয়তো এখন দ্বিপক্ষীয়ভাবে করতে চাইতে পারে। ট্রাম্পের ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে তখন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করতে হতে পারে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় বাড়তে পারে।’