বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম বিতর্কিত অংশ ৭০ অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যরা (এমপি) দলের সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিতে পারেন না। ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে সংবিধান থেকে এই অনুচ্ছেদের বিলোপ চায় অনেক রাজনৈতিক দল। বিএনপিসহ কিছু দল চায় ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার বা সংশোধন, যাতে অর্থবিল ও অনাস্থা ভোট ছাড়া বাকি সব বিষয়ে এমপিরা দলে বিপক্ষে কথা বলতে পারেন। তবে এখনই ৭০ অনুচ্ছেদে হাত দেওয়ার পক্ষে নয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া প্রস্তাব পর্যালোচনায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
অধ্যাপক আলী রিয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশনে মোট ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোট সংস্কার নিয়ে লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। এর মধ্যে বেশির ভাগ দলই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল বা সংস্কার চেয়েছে। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম জামায়াতে ইসলামী। দলটি তাদের প্রস্তাবে অনুচ্ছেদ ৬৭ ও ৭০ নিয়ে বলেছে—‘ফ্লোর ক্রসিং বর্তমানে বন্ধ করা উচিত নয়। এটি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা স্থিতিশীল করতে যুক্ত করা হয়েছিল। আমরা এটি আরও দুই মেয়াদ পর্যন্ত রাখতে চাই। ….যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার হয়, তাহলে এমপিদের বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে, তখন অনুচ্ছেদ ৭০ পুনর্বিবেচনা করা যাবে।’
বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিলে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে। এই বিধানের পরিবর্তন চেয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এমপিরা অর্থবিল ছাড়া সবক্ষেত্রে দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবে—এমন সুপারিশ হয় কমিশনের প্রস্তাবে।
কমিশনের এই সুপারিশের সঙ্গে অনেকটি মিল আছে বিএনপির প্রস্তাবের।
কমিশনকে দেওয়া বিএনপি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংসদকে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে ফ্লোর ক্রসিং সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করা যাইতে পারে। তবে আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা জড়িত প্রশ্নে দলের বিপক্ষে এমপিরা ভোট দিতে পারবে না বলেও দলটির প্রস্তাবে বলা হয়।
অন্যদিকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে সংযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ও ২৫ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার বিধানটি বাতিলের প্রস্তাব করেছে বিএনপি।
এ ছাড়া অন্য দলগুলোর মধ্যে ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার বা সংশোধন চেয়েছে জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, ভাসানি অনুসারী পরিষদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদ। তবে ৭০ অনুচ্ছেদের বাতিল চেয়েছে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাসদ (মার্কসবাদী)। এই দলগুলো ছাড়া আরও বেশ কিছু দল ৭০ অনুচ্ছেদের বাতিল বা সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের কাঠামোতে চর্চিত হচ্ছে একক নেতার ক্ষমতা। সেখানে রাজনৈতিক দলের সংস্কার না করলে তার প্রভাব দলীয় নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ওপর পড়বে। এখন যদি ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার হয়ে আসে কিন্তু দল যদি উৎসাহিত না করে, একক নেতার দল তৈরি হয় তখন নির্বাচিত হয়ে আসলেও ব্যবহার করবে না। কারণ তারা জানেন দলের বিরোধিতা করলে ছিটকে পড়বেন কিংবা নেতার বিরাগভাজন হবেন। তাই দলের সংস্কার হওয়া উচিত।
সংবিধান সংস্কার কমিশনে দলগুলোর জমা দেওয়া প্রস্তাবের মধ্যে আরেকটি আলোচিত বিষয় ছিল সংবিধানে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি। এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাকে মেনে নিয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানসহ গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনের সংবিধানিক স্বীকৃতির প্রস্তাব দিয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিফলন ও স্বীকৃতি সংবিধানের প্রস্তাবনায় থাকা প্রয়োজন বলে মনে করে কমিশনও ।
মুক্তিযুদ্ধ, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্বীকৃতিসহ জামায়াতের প্রস্তাবের বিষয়ে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রস্তাবে আমরা আমাদের কথা বলেছি। অন্যান্য দলও তাদের মতামত দিয়েছি, সবগুলো মিলিয়ে কমিশন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এখন কোনটা গ্রহণ করবে, যোগ-বিয়োগ করবে সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত। তার আগে কিছু বলা সমীচীন মনে করি না।’
সংবিধানের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি জামায়াত ছাড়াও জাতীয় নাগরিক কমিটি, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি) পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি দলও করে। সংবিধান সংস্কার কমিশনও তাদের সুপারিশে মুক্তিযুদ্ধসহ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিফলন ও স্বীকৃতি অবশ্যই সংবিধানে প্রস্তাবনায় থাকা প্রয়োজন বলে মনে করে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অগ্রগতি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, তাদের শুধু প্রস্তাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। তাদের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে, সবাই বোধ হয় তাই চাইবে। তারা প্রকাশ্যে বলুক, তারা যা করেছে অন্যায় হয়েছে। কিন্তু তারপরও তারা যেহেতু লিখিতভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সুতরাং তাদের দিক থেকে অগ্রগতি। এটা রাজনীতিতে জামায়াতের ইতিবাচক পরিবর্তন।
৭০ অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা কোন দলই বাদ দেবে বলে মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, এটা বাদ দিলে দলের ওপর নেতার নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে। দলের এমপিরা নেতৃত্বের নির্দেশ মানবে না। এটা এখন যে আকারে প্রস্তাব থাকুক না কেন কেউ মানবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেনাবেচার যে সংস্কৃতি, এটাকে (৭০ অনুচ্ছেদ) পুরোপুরি তুলে দেওয়া সম্ভব হবে না। এটাকে হয়তো কিছুটা সংস্কার করার সুযোগ রয়েছে। সেটাও করবে কিনা সন্দেহ আছে।
যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে সংরক্ষিত মহিলা আসন নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশেও বিধানটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে জামায়াত। তবে উচ্চকক্ষে নারীদের জন্য ২০টি আসন সংরক্ষণের সুপারিশ করে দলটি। জামায়াত ছাড়া অন্যান্য ইসলামি দলগুলোও এটি না রাখার অনুরোধ করেছে। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন নারীদের জন্য ৫০টি আসনের পরিবর্তে ১০০টি আসনের সুপারিশ করে, যা দেশের নির্ধারিত ১০০টি আসনের জনগণের ভোটে নির্বাচনের পরামর্শ দেয় তারা।
প্রায় সব দলই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের সুপারিশ সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে করেছে। এর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির প্রস্তাবে বলা আছে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের মেয়াদ চার বছর। একই প্রস্তাব জাতীয় নাগরিক কমিটি, গণ অধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। সংস্কার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের মেয়াদ চার বছর।
এদিকে সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি। নাগরিক কমিটি লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডারের অধীনে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের দাবি করে। সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা ফিরে পাবে বলে আশা প্রকাশ করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। তারা তিন পার্বত্য জেলাকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণার পাশাপাশি পাহাড়ি জাতিগুলোর জন্য ১টি মহিলা আসনসন চারটি সংরক্ষিত আসনের প্রস্তাব করে। যা পাহাড়ি জাতিসমূহের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করে।
সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত প্রত্যেকটা প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে কি, হবে না তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের মাধ্যমে নেওয়া হবে।