রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল বৃহস্পতিবার লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে এই সংলাপ শুরু হলো।
কমিশন সূত্র বলেছে, তাদের আহ্বানে সাড়া দেওয়া সব দলের সঙ্গে এক বা একাধিকবার সংলাপ করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে জুলাই সনদ ঘোষণা করবে সরকার। এর ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগে সংস্কার না নির্বাচন—এ নিয়ে কমিশন কোনো চাপে নেই। ঐকমত্য কমিশনের প্রধান হলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘সংলাপ শুরু করলাম। ঈদের আগে আরও দু-একটি দলের সঙ্গে বসার ইচ্ছা আছে। ঈদের পর ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করব। সেখানে প্রতিদিন অন্তত দুটি দলের সঙ্গে বৈঠক করব।’
এদিকে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনে গতকাল মতামত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে।
কমিশন সূত্র জানায়, শুরুতে ছোট দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করা হবে। শেষের দিকে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বড় দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, দুদক ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। এগুলোর মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে বাকি পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে ১৬৬টি প্রশ্নের স্প্রেডশিট ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। জামায়াতে ইসলামী, এলডিপিসহ ১৬টি দল মতামত জমা দিয়েছে। বিএনপি ও জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগামী রোববার মতামত জমা দেবে। বিএনপি বেলা ১টায় ও এনসিপি বেলা ২টায় মতামত জমা দেবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে সব দলের মতামত পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী কমিশন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে গতকাল বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে তুলতে কমিশন যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেখানে সংস্কার হবে। আর যেখানে ঐকমত্য হবে না, সে বিষয়গুলো নিয়ে দলগুলো নির্বাচনের পর জনগণের কাছে যাবে, পরে সংসদে আলোচনা হবে।’
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এলডিপির সংলাপ শুরু হয় বেলা ৩টার পর, জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে। শুরুতে মুক্তিযুদ্ধ এবং জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে সূচনা বক্তব্য দেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এরপর কথা বলেন এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ।
মাঝে আসরের নামাজের জন্য ২০ মিনিট বিরতি দিয়ে এই সংলাপ চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। সূত্র জানায়, বৈঠকে সংস্কার কমিশনের প্রায় প্রতিটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান আলাদা ব্যক্তি হওয়ার প্রস্তাবের পাশাপাশি দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না—এমন প্রস্তাবে এলডিপি সমর্থন জানিয়েছে।
বৈঠকের পর অলি আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে মন খুলে আলোচনা করেছেন। তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা তাদের কাজে লাগাতে বলেছেন। সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় সংশোধন অধ্যাদেশের মাধ্যমেই এখন করা যেতে পারে। যেটা পরে করা যাবে, সেটা সংসদের জন্য রেখে দেবে।
অলি আহমদ বলেন, ‘সব সুপারিশের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের সুপারিশ দুর্বল ছিল। যত কিছুই করেন না কেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারবেন না, যদি না দুজন লোক কাজ না করেন, একজন ওসি, আরেকজন ইউএনও।’ তিনি জানান, ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে তাঁরা একমত প্রকাশ করেন ১২০টিতে। বাকি ৪২টিতে একমত নন। দুটিতে আংশিক একমত এবং দুটি অস্পষ্ট। সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত ৭০টি প্রস্তাবের মধ্যে ৫১টিতে এলডিপি একমত, ১৬টিতে একমত নয়, একটিতে আংশিক একমত এবং দুটি প্রস্তাব অস্পষ্ট বলে মনে করে।
সূত্র জানায়, এলডিপি সংসদের মেয়াদ চার বছর করার বিষয়েও একমত প্রকাশ করেছে।
বৈঠকের পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঈদের আগে তিনটি দলের সঙ্গে সংলাপ হবে। এর মধ্যে আগামীকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টায় খেলাফত মজলিস ও বেলা দেড়টা থেকে লেবার পার্টি এবং রোববার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সংলাপ হবে।
মতামত জমা দিল জামায়াত
রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে গতকাল ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়া মতামতে জামায়াতে ইসলামী সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে। জামায়াতের পক্ষে দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ ও প্রকাশনা সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। কমিশনের পক্ষে অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও মনির হায়দার ছিলেন।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের প্রস্তাবের প্রসঙ্গে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, এটি আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বের ৬০টির বেশি দেশে রয়েছে। এর অনেক ব্যাখ্যা আছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে জামায়াত একমত হলেও বিষয়টি নিয়ে কিছু বক্তব্য তাঁরা দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট স্থাপনের পক্ষে জামায়াত মত দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মামলা পেন্ডিং হয়ে আছে, জনগণ বিচার পাচ্ছে না, একেকটি মামলার বিচার পেতে ১০-২০-৩০ বছর পর্যন্ত মানুষ ঘুরছে।
জামায়াত অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায় জানিয়ে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, তাই সরকারের সংস্কার কাজে সহযোগিতা করছে। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিষয়ে জামায়াত কোনো প্রস্তাব দেয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, মতামতে সেই প্রসঙ্গ ছিল না।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, তাঁদের দল নির্বাচনের দিন, মাস, ঘণ্টা বেঁধে দেয়নি। সময়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন নিরপেক্ষ করা। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, অবাধ নির্বাচনের জন্য ১৫ বছর অপেক্ষা করতে পারি। নির্বাচনের জন্য মিনিমাম সংস্কার প্রয়োজন হলে সে জন্য যৌক্তিক সময় দিতে জামায়াত প্রস্তুত।’ জামায়াত বিদ্যমান সংসদেই সংবিধানের পরিবর্তন চায় বলে জানান মিয়া গোলাম পরওয়ার।
আলী রীয়াজ বলেন, আগে সংস্কার না নির্বাচন প্রশ্নে কোনো ধরনের চাপে নেই ঐকমত্য কমিশন। তাঁদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁরা তা-ই করছেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্যই তাদের অবস্থান বলবে। কিন্তু কমিশন হিসেবে তাঁদের দায়িত্ব সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশগুলো তুলে ধরা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের জন্য একটি জায়গায় যাওয়া। সুতরাং, কমিশন চাপে নেই।