বাংলাদেশে গত বছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ছাত্রআন্দোলন চলাকালে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন চলতি সপ্তাহে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। বাংলাদেশের জন্য গঠিত ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনকে ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ উদঘাটন (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং), দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, ঘটনা কেন ঘটলো—তার মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ, অতীতে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা মোকাবিলা এবং এসবের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে বাংলাদেশের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর তদন্ত শুরু হওয়ার পরে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘ তাদের খসড়া প্রতিবেদন বাংলাদেশকে দেয় মতামতের জন্য। গত সপ্তাহে মতামতসহ প্রতিবেদনটি জাতিসংঘে পাঠায় বাংলাদেশ সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চলতি সপ্তাহের যেকোনও দিন প্রতিবেদনটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রায় ১৩০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে মূলত প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন, এর মূল কারণ কী এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, সে বিষয়ে একাধিক সুপারিশ করা হয়েছে। তবে, এই সুপারিশগুলো বাংলাদেশ মানতে বাধ্য নয়।
আরেকটি সূত্র জানায়, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের নির্দেশে এই ঘটনা ঘটেছে বলে ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন প্রমাণাদি পেয়েছে। একইসঙ্গে ওই ঘটনাবলির আরও তদন্ত করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের জন্য ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠন করা হলেও বাংলাদেশের জন্য এই প্রথম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠন করে জাতিসংঘ।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের শুরু
ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ককে গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে তদন্ত করার জন্য একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠানোর অনুরোধ করে বাংলাদেশ সরকার।
আগস্টে প্রাক-তদন্ত দল ঢাকা আসে এবং সেপ্টেম্বরে মূল তদন্ত কাজ শুরু হয়। ম্যান্ডেট অনুযায়ী ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা হয়।
ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের মূল কর্মপরিধি ছিল— মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাপ্রবাহ উদঘাটন, দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ এবং অতীতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা মোকাবিলা এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে বাংলাদেশের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় মিশনকে।
বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং সংস্থাগুলোকে ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট এবং সেই সময়ের মধ্যে বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের সময়কাল সম্পর্কিত সামাজিক মিডিয়া বা অন্যথায় পাবলিক ডোমেইনে ইতোমধ্যে নেই— এমন তথ্য সরবরাহ করার জন্য অনুরোধ করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন। তাদের প্রতিনিধি দল ভুক্তভোগী, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, চিকিৎসক, সরকারি কর্মকর্তা এবং সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে।
কঠোর গোপনীয়তা
ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কোনও ফৌজদারি তদন্ত নয়। যেকোনও জাতীয় ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়া থেকে স্বাধীনভাবে এটি পরিচালনা করা হয়েছে।
একটি সূত্র জানায়, ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রক্রিয়ায় কঠোরভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। তদন্ত পর্বে দলটি কোনও মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দেয়নি। এমনকি তদন্ত দলের প্রতিনিধিদের পরিচয়ও গোপন রাখা হয়েছিল। যখন তারা বিভিন্নজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাদের পরিচয় সংবলিত কার্ডও (বিজনেস কার্ড) কাউকে দেননি। শুধু পরিচয় হিসেবে যে যার নাম প্রকাশ করে তদন্ত চালিয়েছেন।
কী পেলো ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন
একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জাতিসংঘ মানবাধিকার ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের কাছে একাধিক প্রমাণ রয়েছে।
একটি সূত্র জানায়, একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে পুলিশ কর্মকর্তারা মোবাইল ফোনে একটি ভিডিও দেখাচ্ছেন এবং বলছেন যে যাকে গুলি করি সেই মারা যায়, কিন্তু অন্যরা কেউ দৌড়ে পালায় না। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায় যে ঢাকার একটি স্থানে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে নিরীহ মানুষকে মারছে। এ ধরনের প্রমাণাদি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারের আরেকটি সূত্র জানায়, ওই সময়ে মাঠে উপস্থিত ছিল—এমন প্রতিটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা অন্য বাহিনীকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী করা হয়েছে।
জাতিসংঘ মিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্ব কী
জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে তাদের প্রতিবেদন প্রদান করছে। ফলে সারা বিশ্বের কাছে ওই প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। এই প্রতিবেদনকে পরবর্তী কোনও আইনি প্রক্রিয়ায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ থাকবে।
এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিয়ানমার নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন কাজ করেছিল। ২০১৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট জাস্টিসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যখন মামলা হয়, তখন ওই মিশনের প্রতিবেদনের অনেক রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘একইভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যদি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন প্রমাণাদি খুঁজে পায়, সেটির রেফারেন্স কোর্টে হয়তো ব্যবহার করা যাবে।’