গতবছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকার গঠনের পর দ্বিতীয় বারের মতো আন্তর্জাতিক কোনও ফোরামে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। আছেন বৈশ্বিক ব্যবসায়ী নেতা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান নির্বাহীরাও। বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) সম্মেলনের ফাঁকে ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াবের সঙ্গে এক আলোচনায় অংশ নিয়েছেন ড. ইউনূস। এসময় তিনি কীভাবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন, তার বর্ণনা করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমাকে যখন সরকার চালাতে বলা হলো, আমি সেখানে কিন্তু ‘থ্রি জিরো’ বিষয়টি দেখিনি। আমি দেখেছি যে, করণীয় কী কী আছে। কারণ অনেক হত্যাকাণ্ডের পর একটা সরকার গঠিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠিন হয়ে দাঁড়ালো, তাই সেটি ঠিক করা প্রথম কাজ ছিল। এরপর অর্থনীতিকে সচল করার দরকার ছিল। কারণ সব থমকে ছিল। যখন অর্থনীতির চাকা চালাতে গেলাম, তখন দেখলাম সব ধ্বংস হয়ে আছে। আমি শ্বেতপত্র প্রণয়নে একটা কমিটি করলাম। তাদের রিপোর্ট অনেক চমৎকার ছিল। অনেক বড় অঙ্কের টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। ১৭ বিলিয়ন ডলার শুধু ব্যাংক থেকেই পাচার হয়েছে।
গত বছর জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলছিল, তখন ড. ইউনূস ফ্রান্সে ‘প্যারিস অলিম্পিক’ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। সেময়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘যখন আমি আমার কাজ করছিলাম, বাংলাদেশে কিছু একটা হলো। আমি এমন কিছুর জন্য প্ল্যান করছিলাম না কিংবা প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু কিছু প্রেক্ষাপট এমন বাস্তবতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশে গত জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনের ইস্যু খুবই সাধারণ ছিল। কর্মসংস্থান চাওয়া হচ্ছিল, সবার জন্য সমান সুযোগের দাবি করা হচ্ছিল, চাকরিতে কারও জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার বিরুদ্ধে ছিল এই আন্দোলন। সরকার এবং ছাত্রদের মুখোমুখি অবস্থায় একটি কঠিন পরিস্থিতির তৈরি হলো। সরকার ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো শুরু করলো। এই ঘটনা পুরো প্রেক্ষাপট পাল্টে দিলো। ছাত্ররা এটিকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলো, অস্ত্রের সামনে নিজেদের বিলিয়ে দিলো। কোনও অবস্থাতেই পথ ছেড়ে গেলো না। তখন থেকেই তা হয়ে গেলো অপ্রতিরোধ্য। তরুণরা সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হয়ে আন্দোলনে গেলো নিজেদের কাছ থেকে নিজেরাই বিদায় নিয়ে, হয়তো তারা ফিরে নাও আসতে পারে। এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছিল। যখন গুলিবর্ষণ চলছিল, ছাত্ররা পিছু হটছিল না। যারা গুলি খেয়েছে, তারা পড়ে গেছে রাস্তায়। পেছন থেকে আরেক দল এসে দাঁড়িয়ে গেছে। এরকম বেশ কিছুদিন ধরে হয়েছে। তারপর এক পর্যায়ে ছাত্ররা ডাক দিলো যে, এই সরকারকে বিদায় নিতে হবে। সবদিক থেকে জনগণ এবং ছাত্রদের একটা স্রোত চলে আসলো ঢাকায়।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শেষ দিকের সময়ের বর্ণনা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ছাত্ররা হঠাৎ ঢাকার দেওয়ালে আঁকাআঁকি শুরু করলো। পুরো ঢাকার দেওয়াল ভরে গেলো। তাদের চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা সচ কিছু দেয়াল চিত্রে তুলে ধরলো। এখানে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, কোনও পরিকল্পনা ছিল না। কেউ কোনও প্ল্যান করছিল না, কোনও নেতৃত্ব ছিল না। যেকোনও আন্দোলনে একজন নেতৃত্ব থাকে কিন্তু এখানে তেমন কিছু ছিল না। কোনও দিক-নির্দেশনা ছিল না। একজন ছাত্র গুলি খেয়ে তার বন্ধুদের কোলে পড়ে গেছে এমন দৃশ্য পুরো দেশবাসী দেখেছে, তারপর থেকে প্রেক্ষাপট পাল্টে গেলো। এরপর শুধু তরুণরা না বাসায় থাকা সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। তাতে এটি জনগণের আন্দোলনে পরিণত হলো। হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে পদযাত্রা শুরু করলো। সবাই সিদ্ধান্ত নিলো যে তাকে আর ক্ষমতায় রাখা যাবে না। ৫ আগস্ট তিনি উড়াল দিলেন।’
‘আপনারা গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লবের কথা শোনেন। এই ঘটনা সবগুলো থেকে আলাদা। খুবই স্বকীয়তা ছিল এই ঘটনায় এবং তা এসেছে তরুণদের কাছ থেকে’, বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, কিছুই হয়নি। সবগুলো ভুয়া নির্বাচন ছিল। কেউ ভোট দেয়নি, কিন্তু সে নিজে বারবার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসছিল। একক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসে থাকার কারণে সবার মধ্যে ভীতি কাজ করছিল, যার কারণে তীব্রভাবে জনগণ এই আন্দোলনে সমর্থন দিলো। যখন প্রধানমন্ত্রী উড়াল দিলো, তখন সরকার পড়ে গেলো। এরপর কী হবে— কারও কোনও ধারণা ছিল না, কোনও পরিকল্পনা ছিল না তাদের। সবাই বলছিল যে, আমাদের একটা সরকার লাগবে। আমি প্যারিস অলিম্পিক নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। আমাকে যখন দায়িত্ব নিতে বলা হলো, আমি বললাম— না ধন্যবাদ, আমি পারবো না। কিন্তু তারা হাল ছাড়েনি। আমি বললাম সময় নিয়ে আরও অন্য কাউকে খুঁজতে। তারা ২৪ ঘণ্টা সময় নিলো। যদি কাউকে খুঁজে না পায়, তাহলে আবার আমার কাছে আসবে। ২৪ ঘণ্টা পর আমার কাছে আবার আসলো। তারা বললো যে— কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এভাবেই আমি (প্রধান উপদেষ্টার) দায়িত্বে এলাম।’