রাজধানীবাসীর জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ‘পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও গণমুখী পানি ব্যবস্থাপনা’ নামে ঢাকা ওয়াসার একটি প্রকল্পকে তিনটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে পানি সরবরাহের জন্য পাইপ কেনাকাটার প্যাকেজটির দরপত্রের মূল্য ৩ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটির এই প্যাকেজেই ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, চুক্তি করা প্রতিষ্ঠান থেকে পানির পাইপ না কিনে অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্নমানের পাইপ কেনা হয়েছে। এ নিয়ে সংক্ষুব্ধ চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আদালতে গেলে বেরিয়ে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। চীনের আদালতে লিখিত জবাবে পাইপ সরবরাহ করা একটি প্রতিষ্ঠান বলেছে, তারা এ কাজের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রায় ৬৫ কোটি টাকা ‘সার্ভিস চার্জ’ দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল শনিবার রাতে প্রকল্প পরিচালক ওয়াহিদুল ইসলাম মুরাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে কর্মকর্তারা যেমন জড়িত তেমনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানও জড়িত। এসব তো ওয়াসার ইন্টারনাল বিষয়। বাইরে প্রকাশ করা যায় না। আমরা তো সরকারি চাকরি করি। সব বিষয়ে কথা বলতে পারি না।’
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, মেঘনা নদীর পানি শোধনের জন্য ঢাকা ওয়াসা ‘ঢাকা এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই’ নামে একটি প্রকল্প নেয়। তবে প্রকল্পটি ‘গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প’ নামে বেশি পরিচিত। এই প্রকল্পের তিনটি প্যাকেজের মধ্যে প্যাকেজ–১–এর অধীনে মোট ৩ হাজার ৯৪ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয় ‘সুয়েজ অ্যান্ড এটিভি ভেনেওলিয়া’ নামের প্রতিষ্ঠানকে। ১৬০০ মিলিমিটার ব্যাসের মোট ২৩ কিলোমিটার পাইপ বসানোর জন্য প্রতিষ্ঠানটি ফ্রান্সের সেন্ট গোবিন, জাপানের কুবোট এবং চীনের শিংশিং নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। পরে পাইপ কেনা হয় চীনের শিংশিং এর কাছ থেকে। অবশ্য এই পাইপের অর্ধেক শিংশিং এর কাছ থেকে এবং বাকি অর্ধেক কম দামে শ্যানডং গুয়োমিং নামের চীনের আরেকটি প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে সংক্ষুব্ধ শিংশিং চীনে আদালতের দ্বারস্থ হয়। এদিকে অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের নিম্নমানের পাইপ বসানোর কারণে নানা কারিগরি ত্রুটি বের হলে ঢাকা ওয়াসাও চাপে পড়ে। বিশেষ করে যেসব স্থানে পাইপ জোড়া বা সংযোগ দেওয়া হয়েছে সেখানে তা টেকসই হয়নি। আবার পানির বেগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইপের বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দিচ্ছে।
আজকের পত্রিকার হাতে আসা নথিপত্রে দেখা যায়, বিষয়টি নিয়ে ঢাকা ওয়াসা যখন চাপে সেই সময় আইনি প্রতিকার চেয়ে চীনের আদালতে মামলা করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শিংশিং। চীনের আদালত শ্যানডং গুয়োমিং নামের প্রতিষ্ঠানের কাছে এ বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা তলব করেন। আদালতে শ্যানডং গুয়োমিং জানায়, তারা এ কাজটি পেতে সংশ্লিষ্টদের কম–বেশি ৬৫ কোটি টাকা দিয়েছেন। তবে লিখিত জবাবে এই ‘৬৫ কোটি টাকা’কে সার্ভিস চার্জ দাবি করা হয়েছে। তবে প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) এ ধরনের সার্ভিস চার্জ নামে কিছু নেই।
ঢাকা ওয়াসার সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, পিপিআর (সরকারি ক্রয় বিধিমালা) মেনে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। সেখানে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পুরো প্রকল্পের পাইপ সরবরাহ ও স্থাপনের চুক্তি করা হয়েছে। ফলে অর্ধেক পাইপ নিয়ে দরপত্রের অনুমোদিত তালিকার বাইরে গিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে পাইপ নেওয়ার আইনগত সুযোগ নেই। যদি মূল্যায়নে উত্তীর্ণ হওয়া প্রতিষ্ঠান তিনটি পর পর পণ্য সরবরাহে অপারগতা জানায় তাহলে বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকে মালামাল নিতে পারে। সে ক্ষেত্রেও পিপিআর অনুসরণ করতে হবে। এখানে কার্যত আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে।
ঢাকা ওয়াসার সূত্র জানায়, নানা অনিয়মে জর্জরিত এই প্রকল্পের কাজ মূলত ২০১৩ সালের অক্টোবরে হাতে নেওয়া হয়। তিনটি প্যাকেজে ভাগ করা মূল প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কাজ শেষ না হওয়ায় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ এক দফা বাড়ানো হয়। সংশোধিত প্রকল্পে ২ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এটি এখন ৮ হাজার ১৫১ কোটি টাকার প্রকল্প। পরে আরেক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ালেও শেষ হয়নি। বর্তমানে মেয়াদ বাড়ানোর জন্য নতুন একটি প্রস্তাব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা যায়।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ওয়াহিদুল ইসলাম মুরাদ বলেন, ‘প্রকল্প কবে শেষ হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এখানে নানা কম্পোনেন্ট আছে। কিছু কারিগরি বিষয়ও আছে। আমরা সমাপ্তির বিষয়টি এখনই বলতে পারছি না।’
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, একাধিক প্যাকেজে ভাগ হওয়া প্রকল্পে বারিধারা থেকে রামপুরা এবং বারিধারা থেকে এয়ারপোর্ট রোড, উত্তরা, গুলশান, বনানী ও কচুক্ষেত এলাকায় পানি সরবরাহে ২৩ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। গন্ধর্বপুরে পানি শোধনাগারের পরিশোধিত পানি রাজধানীতে আনতে বারিধারা-ভাটারা ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ করা হবে। ১ হাজার ৬০০ মিলিমিটার ব্যাসের এ লাইনের নির্মাণকাজ চলছে। এই প্রকল্প থেকে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি রাজধানীতে সরবরাহ করা হবে। এর মধ্যে অনিয়মের এই অভিযোগ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চীনের আদালতে মামলা প্রকল্পের কাজে জটিলতা তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুয়েজ অ্যান্ড ওটিভি ভেনেওলিয়া–এর বাংলাদেশি প্রতিনিধি ডায়েম খন্দকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে জড়িত নন বলে দাবি করেন। তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।
বক্তব্য জানতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলুর রহমানের ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।