Homeজাতীয়একাত্তরের মৃত্যুপুরী

একাত্তরের মৃত্যুপুরী


-একাত্তরের মার্চ, আমাদের নেতারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন এহিয়া খান ও ভুট্টোর সাথে। আমরা সুখবরের প্রত্যাশায় আছি; মিটিং মিছিল উত্তেজনায় ভরা দেশবাসী; নেতাদের কাছ থেকে দিকনির্দেশনার অপেক্ষা আছি। আচমকা পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়লো হত্যাযজ্ঞে। আক্রমণ করলো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, পুলিশ লাইন, পিলখানা এবং নিরীহ পথবাসীকে।

তারা জগন্নাথ হলে ঢুকে যেখানে যাকে পেলো হত্যা করলো, রাত্রি শেষে বেচে থাকা কয়েকজনকে দিয়ে সেই মৃতদেহ টানিয়ে এনে জগন্নাথ হল মাঠে গর্ত খুঁড়িয়ে তার মধ্যে মাটি চাপা দিল, জীবিত ক’জনকেও সেখানেই গুলি করলো। রাশি রাশি মৃতদেহ পুঁতে ফেলার এই দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ভবন থেকে অধ্যাপক নুরুল উল্লা। মাঝ রাতে গুলি গোলার আওয়াজে তার ঘুম ভাঙে।

স্বল্প আলোয় দেখলেন যে জগন্নাথ হলের চারদিকে সৈন্য। ছাত্রদের কোনো ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। সৈন্যরা প্রত্যেক ঘর তল্লাশি করছে। ভয়ে তিনি সরে গেলেন। ভোরে আবার দেখলেন- জগন্নাথ হলের মাঠে কিছু ইট পাটকেল আর সাদা কাপড় বিছানো, বিশ-পঁচিশ জন সৈন্য হলের ভিতর থেকে দুইজন আহতকে নিয়ে এলো, সাদা কাপড় উল্টালো; অনেক মৃতদেহ বেরিয়ে পড়লো; আহত দুজনকে মৃতদেহগুলোর পাশে বসিয়েই গুলি করে হত্যা করা হোলো; কিছুক্ষণ পরে সৈন্যরা আরও বেশ কয়েকজন আহতকে হলের ভিতর থেকে নিয়ে এসে মৃতদেহগুলোর পাশে গুলি করে শেষ করে দিল।

এর পর আরো দুই দল মানুষকে একই ভাবে হত্যা। সৈন্যরা জগন্নাথ হলের মাঠের পূর্ব দিক থেকে কিছু বন্দি নিয়ে এলো; তারা সব লুঙ্গি পরা। এরা ছাত্র নয়, বাইরের পথে থাকা সর্বহারা- মুটে মজুর রিক্সাওয়ালা। এদেরকে মৃতদেহের স্তূপের কাছে আনা হোলো। গুলি শুরু হেলো। সবাই ঢলে পড়লো। সৈন্যরা চলে গেলো। সকাল দশটার দিকে একটা বুলডজার এলো।

মৃতদেহগুলোকে মাঠের মধ্যে একটা গর্তে চাপা দেয়া হলো। পঁচিশে মার্চের ওই রাতে পাকিস্তানি মিলিটারি ইকবাল হলেও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তারা গেছে এই অঞ্চলে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের বাসভবনে। আগে থেকে টার্গেট করা অনেক শিক্ষককে ধরে এনে হত্যা করেছে। অবাঙালি সৈন্যদের সাথে বাঙালি সৈন্য বা সামরিক কর্মকর্তাও ছিল এ অভিযানে বলে শোনা যায়। ওই রাতে ঢাকা শহরের পথে পথে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। কত মানুষ হত্যা করেছে তার ইয়ত্তা নাই।

যে শহর ছিল মিছিলের শহর, স্লোগানের শহর; হঠাৎ সে স্লোগান বদলে গেল বুলেটের গর্জনে, সামরিক বাহনের ঘরঘর শব্দে, মৃতদেহের স্তূপে, আগুনের শিখায়। এ নৃশংসতার নজির নেই, ক্ষমা নেই। ঢাকার পিলখানায় ইপিআর বাহিনীর ওপর এবং রাজারবাগে পুলিশ লাইনেও পাকিস্তানিরা আক্রমণ করে। পুলিশ ইপিআর ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। 
তখন থাকতাম খালিশপুরে খুলনা নিউজ প্রিন্ট মিলের কলোনিতে। সাতাশে মার্চ সকালে কলোনির পাচিলের ভিতরের দালান থেকে পাকিস্তানি মিলিটারিদের দিকে গুলি ছোড়া হলো। পাকিস্তানি সৈন্য আহত হলো। অমনি অকল্পনীয় দৃশ্যপট- ‘সে কি আগুন! সে কি বৃষ্টি!’ অচিন্তিত সে গুলির ঝড়, গোলার আওয়াজে সবাই কেপে উঠলাম। হাতের বন্দুক হাতে রইল। মিলিটারিরা এসে হ্যান্ডশেকিং দূরত্ব থেকে স্টেন গান মেশিন গান দিয়ে আমাদের সহযোদ্ধাদের বুক ঝাঁজরা করে দিল।

রক্তের বন্যায় ভেসে গেল পাঁচ বন্ধু। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে দৌড়ে ঘরে ফিরে আতঙ্কে দিশেহারা। এতদিন ওদের দিকে ঢিল ছোড়া হয়েছে- এমন তো ঘটেনি। আজ শুধু পাল্টা গুলি নয়- গুলির বৃষ্টি- বিকট আওয়াজ, নানান দিকে আগুনের লেলিহান শিখা। রাস্তার পাশে রেললাইনের ধারে যত কাচা ঘর ছিল, মাইলের পর মাইল, সব আগুন ধরিয়ে দিয়েছে -শুধু আগুন নয়, গুলি আর গুলি। দেখছি আর ভাবছি- যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার এই পরিণতি। যিনি এ নির্দেশ দিয়েছিলেন, যুদ্ধের নয় মাস তার আর সাড়া পেলাম না।

পাখিমারা বন্দুক দিয়ে আর্টিলারির মোকাবেলার এ ফল- রক্তের বন্যায় ভেসে যাওয়া! সেদিন খুলনা থেকে ফুলতলা পর্যন্ত পথের ধারের সকল প্রতিষ্ঠানেরই এই চিত্র। রাস্তার দুপাশের বস্তি ঝুপড়িতে শুধু আগুনই দেয়নি; নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গরিব নিঃস্ব মানুষদের হত্যা করেছে, খেটে খাওয়া বস্তিবাসীদের আর্ত চিৎকার ভেসে গেছে মিলিটারিদের গুলির গর্জনে। 
আমাদের কলোনির পেছনে ভৈরব নদী। দু’দিনের মধ্যে ভৈরব নদী লাশে ভরে উঠল। তিন চারশ’ গজ চওড়া নদী- শিরোমণি থেকে লবণচোরা প্রায় দশ মাইল নদীর ¯্রােতে দশ বিশ গজ পর পর শুধু লাশ আর লাশ। হাজার হাজার লাশ। ভাটির টানে দক্ষিণে যায়, জোয়ারে ভেসে উত্তরে যায়।

সেই লাশ পিছনে ফেলে, সেই আগুন ঠেলে হঠাৎই গ্রামের বাড়ি পৌঁছে গেলাম। আমার বাড়ি যশোর নড়াইল রাস্তার মাঝামাঝি, বড় রাস্তার পাশে। পথে একজন খবর দিল কালীগঞ্জে আমার শ্বশুর যশোর-ঝিনেদা রাস্তার ওপর মিলিটারির গুলিতে নিহত হয়েছেন। 
খালিশপুর তখন বিহারীদের নিয়ন্ত্রণে। অফিস থেকে বাইরে যাই না; নিউজপ্রিন্ট মিলের পাচিলের ভিতরেই থাকি। রাতে বাসায় থাকি একা। আশপাশে কেউ নেই। ক’দিন আগে পাশের নদীতে লাশ ভেসেছে; এমনি ভয়াবহ নিশুতি রাতে আমি একা। সাতাশে মার্চ যারা পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ করেছিল তাদেরকে খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে গুম করা হচ্ছে। আমাকে যখন তখন ধরে নিয়ে যেতে পারে। যে দু চার জন বাঙালি রয়ে গেছেন কলোনিতে তারা সারাক্ষণ নামাজ দোয়া দরুদ পড়েন, দাড়ি কাটেন না। 
অনেকের মৃত্যু সংবাদ পাচ্ছি। বস্তিবাসী হামিদ মরেছে সাতাশে মার্চ, মিলিটারির গুলিতে মরেছে, আরও এমন কত হামিদ মরেছে ঐ দিন। সহকর্মী সাখাওয়াৎ নেই- বিহারীরা মেরেছে। বিহারী শান মোহম্মদ নিহত- বাঙালিদের হাতে। খুলনার ভাসানী-ন্যাপের নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বারকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে। ইঞ্জিনিয়ার বিশ^াস বাবুর দু ভাই মহসীন স্কুলের পাশের রাস্তায় মোটর সাইকেল চালাচ্ছিল, পাকিস্তানি মিলিটারির গুলিতে শেষ। 
যশোর শহরে আমাদের বাড়ির মাত্র তিন চারটে বাড়ির পরে ললিত ডাক্তারের বাড়ি, কম্পাউন্ডার বিনোদ বাবুকে বিহারীরা মেরে ফেলেছে, শুধু কিল ঘুষি দিয়ে। ছেলেবেলার স্কুলে যাবার পথে প্রফুল্ল ডাক্তারের বাড়ি- সেই প্রফুল্ল বসুকে বিহারীরা পায় পিষে মেরে ফেলেছে। সদা হাস্য গৌরবর্ণ ¯েœহপরায়ণ তার কথা ভাবলে আজো কান্না পায়। তিমির বরণের বাবা ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী; শহর ছেড়ে যাবার পথে নির্মীয়মাণ ঢাকা ব্রিজের তলায় বিহারীরা তাকে হত্যা করেছে।

এই নির্জন ব্রিজের তলায় কতজনকে যে তারা মেরেছে তার হিসাব নেই। শঙ্কর সাহার বাবার খোঁজ মেলেনি কোনো দিন।     জুলাই মাস। প্রতি শনিবার যশোর আসি। একদিন ভোর বেলায় দেখি খালধার রোডের ঢালে এক তরুণের মৃতদেহ পড়ে আছে। কে হত্যা করেছে তার হদিস নেই। লাশটা যেখানে পড়ে ছিল কে কখন যেন ঐ খানেই লাশটা মাটিচাপা দিল। তার স্বজনেরা কিছুই জানলো না। এই সব বেওয়ারিশ, অজানা অচেনা, নদী ভাসা লাশের কোনো গোসল কাফন হয় নি। শুধু গর্ত করে মাটি চাপা।

একদিন সকাল বেলা দৌলতপুরের বড় রাস্তার উপরে মৃতদেহ পড়ে আছে। কারো কোনো কৌতূহল নেই। গাড়ি ঘোড়া মানুষ জন যে যার মতো চলছে। 
মুক্তিযোদ্ধারা আসে, বিভিন্ন জায়গায় এমবুশ করে। যখন তখন যেখানে সেখানে বোমা ফাটে। যেখানে দু একজন পাকিস্তানি সৈন্য মরে, তার প্রতিশোধ নেবার জন্য পাকিস্তানিরা এসে সে গ্রাম জ¦ালিয়ে দেয়। যে পরিবারের কেউ মুক্তি যুদ্ধে গেছে সে পরিবারের বাকি সবাইকে সরকারি লোকজন নাজেহাল করে।

জুলাই আগস্ট নাগাদ থানায় পুলিশ যোগ দিয়েছে। খবর ছড়িয়েছে মুখে মুখে যে, দিনের বেলায় মানুষ ধরা হয় আর রাতের বেলায় খুলনার গল্লামারির বিলে তাদের গুলি করে মারা হয়। সকলে আতঙ্কিতÑ কখন কাকে গল্লামারি যেতে হয়। স্বাধীন হবার পর গল্লামারির খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি গল্লামারির শুকনো বিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের হাড় গোড়, যতদূর চোখ যায় শুধু মাথার খুলি, বুকের পাজর কিম্বা পায়ের হাড় কিম্বা হাত, আস্ত কঙ্কাল নেই। সারা বাংলায় এমন কত গল্লামারি, কত চুকনগর, কত লাশে-ভরা ভৈরব- দেশটা একাত্তরের মৃত্যুপুরী। 
এই মৃত্যুপুরী ভেদ করে কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররা, যুবকরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যুদ্ধে গেছে। সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে বিসর্জন দিয়ে যেসব তরুণ জীবন বাজি রেখে এই মৃত্যুপুরীকে স্বাধীন দেশে রূপান্তরিত করার জন্যে লড়াই করেছিল তাদের স্মরণে এ বৃদ্ধ আজ নোয়ায় শির।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত