ডিফেন্ডিং ছাত্রলীগ
“ছাত্রলীগ” শব্দটি শুনলেই আপনার মনে যে চিত্র ভেসে উঠবে, তাহলো এটি একটি জঘন্য সংগঠন, যার কাজ শুধু খুন-খারাবি করা। বাংলাদেশের সব অপকর্মের ৯০%-এরই জন্য দায়ী এরা! এবং আপনি যদি বর্তমান আওয়ামী লীগের টেমপ্লেটধারী নেতা হোন, তাহলে এদের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজের গা বাঁচাতে সম্ভবত ২ বার ভাববেন না। আর যদি সুশীল হোন, তাহলেও ১৯৭১-এর পর ছাত্রলীগের আর কোনো ভালো কাজের কথা আপনার মুখ দিয়ে বের হবে না।
কারণ কী? কারণ, বছরের পর বছর ধরে মিডিয়া আপনার মন ও মননকে এভাবেই তৈরি করেছে। পর্যাপ্ত তথ্য সম্পর্কে আপনার চিন্তা করার অনভ্যাস সৃষ্টি করা হয়েছে। আমিও এই লেখার ক্ষুদ্র পরিসরে আপনাকে খুব বেশি তথ্য দিতে পারবো না। তবে চিন্তা করার জন্য কিছু কিছু সূত্র ধরিয়ে দেবো।
১.
প্রথমেই আসি গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের হাতে অছাত্রলীগার কারা কারা খুন হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বজিৎ এবং আবরারের পর আর তৃতীয় কোনো নাম উল্লেখ করতে পারবে না। তবে শিবিরের লোকজন আরেকটি নাম প্রচার করে। তাহলো আবু বকর। ছাত্রলীগের হার্ডকোর বিরোধী লোকজনের দ্বারা লিখিত উইকিপিডিয়ার একটি নিবন্ধে আরো কয়েকটি নাম পাবেন। পুরো নামের লিস্ট: আবরার, বিশ্বজিৎ, আবু বকর, নাহিদ, জুবায়ের, সাদ ইবনে মমতাজ এবং “তোফাজ্জল হোসেন”। এদের মধ্যে আবরার ফাহাদই একমাত্র ছাত্র, যাকে শিবির সন্দেহে পেটানো হয়। এবং সেটা পেটানোর জন্য পেটানো। খুন করাই মূল উদ্দেশ্য ছিলো না। বিশ্বজিতকে হরতাল সমর্থক হিসেবে আক্রমণ করা হয়। সাধারণ ছাত্র/মানুষ আবু বকর এবং নাহিদ মারা যান ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারির মাঝখানে পড়ে। জুবায়ের এবং সাদ নিজেরা ছাত্রলীগ করতো। অন্তর্কলহে খুন হয়। আর সাবেক ছাত্রলীগার তোফাজ্জল হোসেনকে ভাত খাইয়ে পিটিয়ে মারে সমন্বয়করা, যার দোষও চাপানো হয়েছে ছাত্রলীগের ওপর, যখন ছাত্রলীগাররা জান বাঁচাতে নিজেরাই ক্যাম্পাসছাড়া। এই তালিকার একমাত্র আবরার ছাড়া আর কাউকেই বিপক্ষ দলের রাজনীতি করার জন্য খুন করা হয় নাই।
আপনি খুঁজলে হয়তো আরো দুয়েকজন পেতে পারেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর খুনের ইতিহাসের সাথে তুলনা করলে খুন বিচারে গত ১৫ বছরের ছাত্রলীগকে ফেরেশতা বলা যায়। অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর খুনের ইতিহাস খুঁজে দেখবেন। আমার এই লেখার কাজ সেই তালিকা করা না। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়েই ছাত্রশিবির ব্রাশ ফায়ার করে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের ৮ জন নেতাকে খুন করে। আপনার এক্সপেক্টেশন যদি হয় অন্য সবার হাতে মার খেয়েও ছাত্রলীগ টুশব্দ করতে পারবে না, তাহলে আমার বলার কিছু নেই।
আপনার প্রশ্নের তালিকায় এরপর অবশ্যই আসবে তথাকথিত মানিকের সেঞ্চুরি। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ক্যাডার ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্পাদক জসীমউদ্দীন মানিক কী করে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে এবং তার নামে প্রচলিত সকল মিথের জবাব আছে এই পোস্টে ( https://thedailycampus.com/opinion/54835/ ); সময় থাকলে পড়ে নিতে পারেন। লেখার মন্তব্য নিয়ে আরেকটি পোস্ট এখানে…( https://thedailycampus.com/mukto-column/55016/ )। অনুপ্রবেশ ঠেকানোর ব্যর্থতা ছাত্রলীগের রয়েছে, তবে ব্যক্তির কৃত অপরাধ বা প্রতিপক্ষের গুজবের দায় অবশ্যই ছাত্রলীগের নয়।
এরপর ক্যাম্পাসে চড়-থাপ্পড়, ক্যান্টিনে ফাও খাওয়া, জোর করে মিছিলে নিয়ে যাওয়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি – এগুলো ফেরেশতা স্ট্যান্ডার্ডে অবশ্যই খারাপ কাজ। কিন্তু, বাংলাদেশের বাস্তবতায় সব দলই করে। সুতরাং, সংগঠন ছাত্রলীগকে সিঙ্গেল আউট করার কোনো সুযোগ নেই। এই অপরাধগুলো ব্যক্তির এবং এসব ব্যক্তিদের বিচার হওয়া উচিত। এর জন্য সংগঠনকে দায়ী করলে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের অস্তিত্ব থাকবে না।
২.
ছাত্রলীগ সম্পর্কে এরপর সবচেয়ে বড়ো অভিযোগ হলো পদবাণিজ্য। এটি ছাত্রলীগ/আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সুতরাং এই বিষয়ে বাকিদের অভিযোগ করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বরং অন্য রাজনৈতিক দলগুলো খুশি হওয়া উচিত যে, এভাবে ছাত্রলীগে অযোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে, এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে ছাত্রলীগ/আওয়ামী লীগ দুর্বল হচ্ছে। ছাত্রলীগের এই পদবাণিজ্যের জন্য ছাত্রলীগের নেতাদের অবশ্যই দায় আছে। তবে যেহেতু এখানে আমি ছাত্রলীগকে ডিফেন্ড করবো, সেহেতু এই পিকচারের বাকি এন্টিটিগুলো সম্পর্কেও একটু চিন্তার খোরাক দেই। প্রথমত, বাংলাদেশ একটি দুর্নীতিপরায়ণ দেশ। এখানে যে যেভাবে পারে, টাকা পয়সা করে নেয়। ছাত্রলীগের নেতারাও বাংলাদেশেরই লোক, ভিনগ্রহের প্রাণি নয়। তবে পদবাণিজ্যের মূল দায় “উপর” থেকে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের। আইনত ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গ-সংগঠন না, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। কিন্তু, ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের উপর মহল। আওয়ামী লীগের উপরমহল যেমন এমপি নমিনেশনে বাণিজ্য করে, এখানেও টাকা পয়সা এবং কে কার অনুসারী, সে হিসাব চলে আসে। আমি যদি ১ কোটি টাকা খরচ করে সেন্ট্রাল ছাত্রলীগের পদ নেই, তাহলে আমিও চেষ্টা করবো বিভিন্ন শাখায় পদ দিয়ে ২ কোটি উঠাতে। পদবাণিজ্য বন্ধ করতে তাই আওয়ামী লীগকে কন্ট্রোল করতে হবে, ছাত্রলীগে ঝাঁড়পোছ করে কোনো লাভ হবে না।
৩.
পরের অভিযোগ ছাত্রলীগের শিবিরের অনুপ্রবেশ না ঠেকাতে পারা। শিবির পারলে কেন ছাত্রলীগ পারে না? এখানে আপনাকে ফিরে যেতে হবে কোন দল কীভাবে কাজ করে, তার ওপর। শিবিরে কেউ নিজে থেকে ঢোকে না, শিবিরই কাউকে দলে ঢোকায়। তারা প্রথমে টার্গেট ঠিক করে। এরপর তাকে অনুসরণ করে যদি লাইনে আনা যাবে বলে মনে হয়, তারপর ধাপে ধাপে রিক্রুট করা হয়। অন্যদিকে, ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ হলো আমজনতার দল। এখানে যে কেউই মিছিল করতে পারে, অ্যাকটিভ হতে পারে। পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না। হয়তো গোলাম আযমের নাতিকে আপনি আইডেন্টিফাই করতে পারবেন; কিন্তু আপনি চাইলেও জামায়াত-শিবিরের অনুপ্রবেশ পুরোপুরি আইডেন্টিফাই করতে পারবেন না। ছাত্রলীগের মতো বড়ো একটি সংগঠনের বিভিন্ন পদে হাজার হাজার নেতা। আপনি কয়জনের বাবামায়ের বায়োডেটা চেক করতে পারবেন?
এখানে অনুপ্রবেশের আরেকটি স্ট্রাটেজি উল্লেখ করা প্রয়োজন। আপনি দেখবেন, নুরুল হক নুর, সারজিস, হাসনাতের মতো নির্লজ্জ লোকজন আগে ছাত্রলীগ করতো। কিন্তু, এরাই এখন ছাত্রলীগের ঘোরতর বিরোধী। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? এদের ওপর কি ছাত্রলীগ কোনো নির্যাতন করেছিলো, যার কারণে এরা দলত্যাগ করতে বাধ্য হয়? না। এরা শিবিরও না। এরা হলো মেটিকুলাস প্ল্যানের অংশ। বাংলাদেশের রেজিম চেঞ্জে জড়িত আমেরিকান প্রতিষ্ঠানের এক রিপোর্টে দেখা যায় “হিট” আছে এরকম শোবিজ তারকা, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট এবং অন্যান্য তরুণদেকে তারা প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো আন্দোলনের জন্য। সারজিস, হাসনাতরা এরকমই প্রোডাক্ট। এরা অসম্ভব বাকপটু, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং যথারীতি ক্ষমতা ও অর্থলোভী। এদের দল ত্যাগ, অথবা ছাত্রলীগের মধ্যে থেকে ছাত্রলীগকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা আপনি সহজে ঠেকাতে পারবেন না। ছাত্র হিসেবে আপনি কি পড়াশুনা করবেন, সুস্থ রাজনীতি করবেন, নাকি এদের সাথে সি’আইএ-কেজিবি খেলার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে পারবেন?
৪.
ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করার পেছনে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে মিডিয়া ক্যু। আগেই বলেছি, ছাত্রলীগ কোনো ফেরেশতাদের সংগঠন নয়; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদেরকে সিঙ্গেল আউট করার মতো কোনো অপকর্ম তারা করেনি। তারপরও তাদের দুর্নামের কারণ কী? কারণ, মিডিয়া। প্রথম আলোসহ বাংলাদেশের বেশিরভাগ মিডিয়াই আমেরিকা-জামায়াতের মেটিকুলাস পরিকল্পনার অংশ। আপনি টেস্ট কেস হিসেবে নুরুল হক নুরের মার খাওয়ার ঘটনা বিবেচনা করে দেখতে পারেন। আপনি যদি লীগের সমর্থক হয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই ছাত্রলীগের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত হতেন পিটিয়ে পিটিয়ে এই নুরকে কেন নেতা বানানো হচ্ছে! কিন্তু, আপনি কি চিন্তা করে দেখেছেন, নুরু মাথায় পট্টি বাধা অবস্থায় অচেতন হয়ে পড়ার পরদিনই আবার রাস্তায় কিংবা টক-শোতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে? অসংখ্যবার হয়েছে। অর্থাৎ, তার সিরিয়াল মার খাওয়ার ঘটনা বেশিরভাগই ছিলো অভিনয় এবং মিডিয়ার মাধ্যমে সেটিকে “মুমূর্ষু” অবস্থা হিসেবে দেখানো হয়েছে। ছাত্রলীগ কি অভিনেতা নুরুকে এড়াতে পারতো না? না। কেউ যদি আপনার সাথে পায়ে পা দিয়ে কনফ্লিক্ট তৈরি করতে চায়, আপনি নিজে তা কতোক্ষণ এড়াতে পারবেন?
সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনার দায়িত্ব ঘটনা আসলে কী ঘটেছে, তা সম্পর্কে আদ্যোপান্ত চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়া, মিডিয়ার সঙ্গে তাল মেলানো নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আওয়ামী লীগের উপর মহলও মিডিয়ার ভয়ে ছাত্রলীগকে দরকারের সময় সাপোর্ট না দিয়ে ডিজঔন করেছে। ছাত্রলীগ না থাকলে যাদের অস্তিত্ব থাকে না – যেটি বর্তমান বাস্তবতা – তারাও গা বাঁচাতে ছাত্রলীগকেই ত্যাজ্য করতে চেয়েছে। ছাত্রলীগ আপনার কনডম নয়, ছাত্রলীগ আপনার প্রাণভোমরা।
৫.
ছাত্রলীগকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র কেন করা হয়েছে, এ বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। আপনি একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন, আইনত আওয়ামী লীগের অংশ না হলেও রাজপথের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে লীগ পক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ হলো ছাত্রলীগ। জীবন-জীবিকা, পরিবারের প্যাঁচে আটক যুবলীগ মূলত একটি ঢোঁড়াসাপ সংগঠন। রাস্তার রাজনীতিতে তাদের কোনো বেইল নাই। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে পারে একমাত্র ছাত্রলীগ। আর যে কোনো দলেরই ভবিষ্যতের জন্য তার ছাত্র সংগঠন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারাই রাজনীতির উত্তরসূরি। ছাত্রলীগ শেষ মানে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত শেষ। গত ১৫ বছর ধরে তাই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অলআউট ষড়যন্ত্র হয়েছে। গত ১৫ বছরের ছাত্ররা বিএনপি-জামায়াতের শাসন দেখে নাই, ছাত্রদল-শিবিরের নৃশংসতা সম্পর্কে তাদের ধারণা নাই বললেই চলে। তাদের কাছে ছাত্রলীগকে ঘৃণার বস্তু বানানো অর্থ বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতির ভবিষ্যতের বাঁধা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। সেই “ভবিষ্যত” ইতোমধ্যে বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যজনক বর্তমান।
আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে ছাত্রলীগকে সহযোগিতা করেনি, এমনকি ছাত্রলীগকে স্বাধীনতাও দেয়নি নিজেদেরকে ডিফেন্ড করার। তাদের ওপর মাতব্বরি করেছে। এক ওবায়দুল কাদেরই ছাত্রলীগকে যে পরিমাণ বাঁশ দিয়েছেন, যেভাবে ধ্বংস করেছেন, তার বিস্তারিত আলাপে গেলে উপর মহলের অনেকেরই লুঙি পরনে থাকবে না।
#ATeam 20241103
@topfans