গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দেশের “প্রথম” নারী মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, “কমান্ডার সোহরাব হোসেন সেনাবাহিনীর সৈনিকদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করছিলেন, সেই সময় খালেদা জিয়া প্রথম বলেছিলেন, তোমরা অস্ত্র সমর্পণ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না জিয়াউর রহমান ফিরে আসেন। এই দিয়ে তার শুরু।” এবং শুরুতেই শেষ নয়, দুই শিশু মুক্তিযোদ্ধা (মির্জা ফখরুলের মতে) তারেক ও কোকোসহ খালেদা জিয়া পাকিস্তানের হাতে “বন্দী” ছিলেন।
মির্জা ফখরুলের এ কুযুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তি দেয়ার কাজে বেশি সময় ব্যয় করতে চাই না। আজ মহান বিজয় দিবসে বরং কথা বলবো বিএনপির রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের যে বয়ান বিনির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছে, সেটি নিয়ে। ১৯৭১ সালে বিএনপি ছিলো না। বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর “সুপ্রীম কমান্ডার” ছিলেন, তাঁর অধীনে সবাই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ একজন নির্দিষ্ট মানুষের যুদ্ধ ছিলো না, এই জনযুদ্ধে বাংলার মুক্তিকামী প্রতিটি মানুষের ভূমিকা ছিলো। সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার পুরস্কারও পেয়েছেন, যদিও একজন মুক্তিযোদ্ধার অবদানকে কোনো পুরস্কার দিয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না।
আমি সামরিক শাসন পছন্দ করি না। তাই জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে আসুন, সেটি চাই নি। তবে এটি তার ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ। তাই এ বিষয়ে সমালোচনাও করি না। আমি শুধু চাই, স্বাধীন বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করবে, তারা যেন স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষ হয়। জিয়াউর রহমান এখানে আমাকে হতাশ করেছেন। তিনি এন্টি-আওয়ামী শক্তিকে এক ছাতার তলে নিয়ে আসাকেই প্রায়োরিটি দিয়েছেন, গোলাম আযমের মতো দাগী যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশে পুনর্বাসন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার সামর্থ্য তার ছিলো। কিন্তু তিনি সে পথে না গিয়ে সহজ পথে হাঁটতে গিয়ে ১৯৮১-তে হোঁচট খেয়েছেন। তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকাররা তার এই পরিচয় কখনোই ভুলে না যতোই তাদেরকে বুকে টেনে নিন, এটি তার মাথায় রাখা উচিত ছিলো। তবে জীবদ্দশায় তিনি নিজেকে কখনো স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবী করেছেন, এমন কোনো ডকুমেন্ট আমার চোখে পড়ে নি।
কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে আসার যে শুরুটি করে দিয়েছিলেন, তার উত্তরসূরিরা সেটিকে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এরপর জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানো হয়েছে, দেশের “প্রথম” প্রেসিডেন্ট বানানো হয়েছে, আর গত কয়েক বছর ধরে তো খালেদা জিয়াকেই “প্রথম” নারী মুক্তিযোদ্ধা বানানো হচ্ছে। বিএনপির এই “প্রথম” ফেটিশের শানে নুযূল বুঝতে আমি অক্ষম। জিয়াউর রহমান একসময় – যেভাবেই হোক – প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, খালকাটাসহ বেশকিছু উন্নয়নমূলক কাজেরও চেষ্টা করেছেন। হোক না হ্যাঁ-না ভোট, তাতে তো নিজের ৯৭% জনপ্রিয়তা দেখিয়েছেন! হ্যাঁ-না ভোট নিয়ে একটু মজা করলাম। অবশ্যই এখানে কারচুপি হয়েছে। তবে সত্য হলো, জিয়াউর রহমান তার শাসনকালে জনপ্রিয় ছিলেন। আওয়ামী লীগের ব্যাকফুটের সুযোগে তিনি প্রমাণ করতে পারতেন, বীরউত্তম জিয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চান। তিনি সেটি করেন নি। এখন তাকে দেশের “প্রথম” প্রেসিডেন্ট বানিয়ে কোন মহৎকর্ম সম্পাদন হচ্ছে, সেটি বুঝতে আমি অক্ষম।
খালেদা জিয়ার স্বাধীনতাবিরোধী তোষণ বুঝা অবশ্য সহজ। তিনি যখন রাজনীতিতে ঢুকেছেন, তখন বিএনপি বিপদে। রাজনীতির অভিজ্ঞতাও তার ছিলো না। একজন গৃহবধু ২টি ছোট সন্তানকে নিয়ে বিএনপির মতো একটি বড়ো দলকে সামলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকে তাকাতে গেলে তিনি টিকতে পারতেন না। জিয়া যেটি করতে পারতেন, খালেদা জিয়ার পক্ষে সেটি সম্ভব ছিলো না। এই পাঁকে নিজেকে জড়িয়ে ডুবতে ডুবতে তিনি ১৫ই আগস্ট নিজের জন্মদিন পালনের মতো নির্মম নির্বুদ্ধিতাও করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অবস্থান নিয়ে অনেক ধরনের কথা আছে। বইয়ের রেফারেন্স দিয়ে বলা যাবে, জিয়াউর রহমান তাকে নিজের কাছে নিতে চাইলেও তিনি পাকিস্তানীদের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে থাকাকেই নিরাপদ মনে করেছেন। এ ব্যাপারে আমি তার সমালোচনা করতে চাই না। ২টি শিশু সন্তানসহ কোনো নারী যদি নিরাপদ আবাসস্থান ছেড়ে স্বামীর কাছে যাওয়ার ঝুঁকি না নিতে চায়, তাহলে তাকে দোষ দেয়া যায় না। তবে তিনি অবশ্যই বন্দী অবস্থায় ছিলেন না। তার সাথে পাকিস্তানীরা ভালো ব্যবহারই করেছে। তার শাসনামলে এক পাকিস্তানী উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা মারা গেলে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ভেঙ্গে কৃতজ্ঞতাবশত সেখানে ছুটে গিয়েছেন। ২টি শিশুসন্তানের জননী বেগম গৃহবধু জিয়া অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না।
দল হিসেবে বিএনপিতে অবশ্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন। একবারের মুক্তিযোদ্ধা চিরকাল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নাও ধারণ করতে পারেন। কিন্তু এর অর্থ এই না যে, বিএনপি করলেই একজন মুক্তিযোদ্ধা আদর্শবিচ্যুত হয়ে গেলো। একইভাবে আওয়ামী লীগ করলেই একজন অমুক্তিযোদ্ধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠেন না। বিএনপিতে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন, কিছুটা হলেও ধারণ করেন, আমি চাই দেশের স্বার্থে তারা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠুন। তারা যেন সত্যিকার অর্থেই মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের গৌরবকে স্যালুট জানান। তাকে “প্রথম” ফেটিশের রাজনীতির নোংরা কাদা থেকে উদ্ধার করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলে জিয়ার সম্মান কমে না, বাড়ে। সেই জিয়াকে মানুষ টুপি খুলে কুর্ণিশ করবে। কিন্তু তাকে “স্বাধীনতার ঘোষক” বা “প্রথম প্রেসিডেন্ট” বানাতে গেলে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াকে মানুষ এমনভাবে অশ্রদ্ধা করবে, যেটি তার প্রাপ্য নয়।
আমি আশা করবো, বিএনপির বোধোদয় হোক। দেশ আজ স্বাধীনতাবিরোধীদের কব্জায়। আওয়ামী লীগের কার্যত অনুপস্থিতি বিএনপির জন্য একটি বিরাট সুযোগ। তারা সে সুযোগটা নিক, স্বাধীনতার পক্ষের একটি দল হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলুক। রুখে দিক ইউনূসের রিসেট বাটন।
আর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুনলাম, জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে সিএমএইচে নিতে হয়েছে। আশা করি তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। এই বয়সে এই অসুস্থ শরীরে খালেদা জিয়াকে প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা বানানোর মতো চাপ না নিয়ে গঠনমূলক রাজনীতি করলে তার নিজেরও ভালো, দেশেরও ভালো।
#ATeam 20241244