Homeআন্তর্জাতিকগাজায় যুদ্ধবিরতি: ট্রাম্পের অপেক্ষায় নেতানিয়াহু

গাজায় যুদ্ধবিরতি: ট্রাম্পের অপেক্ষায় নেতানিয়াহু

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে শরু হওয়া ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের মধ্যকার আলোচনাটির এখন অচলাবস্থা। এর প্রাথমিক কারণ, যুদ্ধ শেষ করতে ও অবশিষ্ট সব জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীকে প্রত্যাহার করতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অস্বীকৃতিএমন কথাই বলেছেন মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর তিন আরব কর্মকর্তা। গত সপ্তাহে টাইমস অব ইসরায়েলের সঙ্গে কথা বলার সময় এসব তথ্য জানান তারা।

অল্প সংখ্যক জিম্মির বিনিময়ে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সাম্প্রতিক প্রস্তাব হামাসও যে প্রত্যাখ্যান করেছে এ বিষয়টিও স্বীকার করেছেন কর্মকর্তারা। তবে তারা যুক্তি দিয়েছিলেন, সেই প্রস্তাবগুলো ব্যর্থ হওয়ার পেছনে ধ্বংসাত্মক কারণটি ছিল, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি দীর্ঘদিন ধরে স্পষ্ট করে বলে আসছিল, তারা এমন কোনও কাঠামো গ্রহণ করবে না যেটি ইসরায়েল গাজায় আবার যুদ্ধ শুরু করতে পারবে তা নিশ্চিত করে।

মিসর ও কাতার যদি জানতই যে, হামাস এ ধরণের প্রস্তাব গ্রহণ করবে না, তবে তারা কেন অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য এই ধরণের প্রস্তাবগুলো অগ্রসর করার চেষ্টা করেছিলেন জানতে চাইলে, জবাবে আরব কূটনীতিকদের একজন বলেছিলেন, বাইডেন প্রশাসন এই ধারণাটি চাপিয়ে দিয়েছিল যেটি মধ্যস্থতাকারীদের সম্ভাব্য প্রতিটি উপায়ে এগিয়ে যেতে উৎসাহ যুগিয়েছিল।

আলোচনাধীন চুক্তিটি গাজায় যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার ও আইডিএফকে সেখানে অবস্থানের অনুমতি দেয়। আর এই দুটি শর্তেরই ঘোর বিরোধিতা করে হামাস। অবশ্য আরব মধ্যস্থতাকারীরাও হামাসের এই রেড লাইনকে সমর্থন করতে ইচ্ছুক ছিল। তবে এই দুটি শর্ত অন্তর্ভুক্ত করে না এমন চুক্তির বিরোধিতা করেছেন নেতানিয়াহু। আর তার এই অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কূটনীতিকরাও।

দ্বিতীয় আরব কূটনীতিক বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিষয়গুলোকে একইভাবে দেখে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার সময় এসেছে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের অবস্থান মেনে নেবে না।’

এই দুটি দাবিতে নেতানিয়াহুর অনাগ্রহের ব্যাখ্যা দিয়ে জিম্মি আলোচনার সঙ্গে পরিচিত একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেছেন, গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার সেই ‘বিজয়ের ছবিটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে’ যেটি আঁকার চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী।

যুদ্ধ শেষ করতে নেতানিয়াহুর অনিচ্ছা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি-না তা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি ইসরায়েলি কর্মকর্তা। প্রধানমন্ত্রীর সমালোচকরা যতটা যুক্তি দিয়েছেন, সেটি নেতানিয়াহুর ডানপন্থি জোটের অংশীদারদের সেই প্রতিশ্রুতির দিকে ইঙ্গিত করে। ডানপন্থিরা সতর্ক করেছিল, যুদ্ধ শেষ করে নেতানিয়াহু যদি এমন একটি জিম্মি চুক্তিতে রাজি হয় তবে সরকার পতনের ডাক দেবে তারা।

প্রথম আরব কূটনীতিক অনুমান করেছিলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নেতানিয়াহুর কৌশলটি ছিল, নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন দুই মাসের মধ্যে হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করবেন, তখন তিনি ইসরায়েলের পক্ষে আরও ভালো কিছু যুদ্ধবিরতি শর্তাবলী সুরক্ষিত করতে আলোচনায় জুড়ে দেবেন।

মধ্যস্থতাকারী দেশের আরব কূটনীতিক বলেছেন, ‘এই কৌশলটি ভুল। কেননা, ট্রাম্প দায়িত্বে রয়েছেন শুধু এই কারণে হামাস তাদের প্রধান দাবিগুলো থেকে সরে আসবে না।’

জিম্মিদের পরিবারগুলোও সতর্ক করেছিল, সম্ভবত আরও দুই মাস তাদের প্রিয়জনদের পক্ষে বন্দিদশায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। তারা বাইডেন প্রশাসন ও আগত ট্রাম্প প্রশাসনকে ২০ জানুয়ারিতে ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানের আগেই একটি চুক্তি সুরক্ষিত করতে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।

শনিবার আইডিএফ বলেছে, সম্প্রতি উত্তর গাজায় আইডিএফ এর বোমা হামলায় এক নারী জিম্মি নিহতের যে দাবি হামাস করেছে তা তদন্ত করছে।

গত মাসে টাইমস অব ইসরায়েলকে ট্রাম্পের সাবেক কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে একমত যে, যুদ্ধের পরে গাজায় অবশিষ্ট ইসরায়েলি বাহিনীর উপস্থিতি মেনে নিতে বাইডেনের চেয়ে ট্রাম্প আরও বেশি আগ্রহ দেখাতে পারেন।

তবে এর মানে এই নয় যে, হামাস এই ধরণের শর্তে অবশিষ্ট সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়ে যাবে। কেননা, জিম্মিদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি একটি চাল হিসেবে দেখে যেটি ব্যবহার করে তারা গাজা থেকে ইসরায়েলকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করতে পারবে—এমনটাই মনে করেন ওই ইসরায়েলি কর্মকর্তা।

যুদ্ধের অবসান ও ইসরায়েলি বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করতে সম্মত হওয়া সম্ভবত হামাসকে কোনও না কোনও আকারের লঙ্ঘন করতে উৎসাহ দেবে। তবে আরব কর্মকর্তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, এটি একটি অনিবার্যতা।

প্রথম আরব কূটনীতিক যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘হামাসকে শাসক হিসেবে নিয়োগের জন্য ফিলিস্তিনিরা সবসময়ই সংবেদনশীল থাকবে। তবে যুদ্ধ যত দীর্ঘতর হবে এই প্রবণতা ততই বাড়বে। তবে জিম্মিরা জীবিত থাকবে কি-না অনিশ্চিত।’

নেটজারিম করিডোরের দিকে ইঙ্গিত করে দ্বিতীয় আরব কূটনীতিক বলেন, ‘এদিকে, আমরা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে গাজায় অনির্দিষ্টকালের জন্য অবকাঠামো স্থাপন করতে দেখছি।’

নেটজারিম করিডোরের আইডিএফ পাঁচ কিলোমিটার প্রশস্ত সংরক্ষিত সামরিক অঞ্চলে স্থাপন করেছে। সেখানে ইসরায়েল থেকে সেলুলার টাওয়ার ও পানির সরবরাহের লাইনও স্থাপন করা হয়েছে।

আরব কূটনীতিক সমালোচনামূলকভাবে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, নেতানিয়াহু গাজায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের যে কোনও ভূমিকাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং পিএকে-কে তিনি হামাসের সঙ্গে তুলনা করেন। তবে একটি চূড়ান্ত দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের জন্য একটি রাজনৈতিক দিগন্ত তৈরির জন্য রামাল্লাকে হামাসের একমাত্র কার্যকর বিকল্প হিসেবে দেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তবে এই কাঠামোটিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে ইসরায়েল।

যুদ্ধের প্রথম বছরের অধিকাংশ সময় গাজায় যুদ্ধ পরবর্তী ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করার জন্য ইসরায়েলকে অনুরোধ জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে ওয়াশিংটনের এমন অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নেতানিয়াহু। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, হামাস যতক্ষণ পর্যন্ত গাজার ক্ষমতায় থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত যেকোনও প্রচেষ্টা নিরর্থক।

তবে অতি সম্প্রতি তিনি এটি স্বীকারও করেছিলেন যে, হামাসকে পুনরায় সংগঠিত হওয়ায় বাধা দেওয়ার জন্য হলেও, গাজায় মানবিক সহায়তা বিতরণ পরিচালনার জন্য একটি বিকল্প শক্তি থাকা দরকার।

ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেছেন, পিকে-কে সেই ভূমিকা পালনের অনুমতি দিতে অস্বীকার করার পর, নেতানিয়াহু অবশ্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে এই অঞ্চলের পুনর্গঠনের কাজে জড়িত করার ধারণাটি উপভোগ করতে শুরু করেছেন।

তবে আবুধাবি অবশ্য বারবার স্পষ্ট করেছে, একটি সংস্কারকৃত পিএ যদি একটি দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের বিশ্বাসযোগ্য পথের অংশ হিসেবে না দাঁড়ায়, তবে দেশটি গাজার পুনর্গঠন ও ব্যবস্থাপনাকে সমর্থন করবে না। তবে এই শর্তগুলো মেনে নিতে অস্বীকার করে ইসরায়েল।

আরব কূটনীতিক যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানে নেতানিয়াহুই একটি চুক্তির প্রধান বাধা, যদিও তা প্রকাশ্যে বলতে অস্বীকার করে দেশটি।’

হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একজন মুখপাত্র এই দাবির বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি টাইমস অব ইসরায়েলকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মন্তব্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, হামাসের সহযোগিতার অভাবে আজ পর্যন্ত একটি চুক্তি সম্ভব হয়নি।

একই রকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নেতানিয়াহুর একজন মুখপাত্রও। তিনি হামাসের দিকে আঙুল তুলে বাইডেনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একাধিক দাবির কথা তুলে ধরেছেন।

মুখপাত্র জোর দিয়ে বলেন, ‘হামাস চুক্তির একমাত্র বাধা ছিল এবং রয়ে গেছে।’

ব্লিঙ্কেন বলেন, হামাসের অস্থিরতার কারণে গত মাসের শেষের দিকে কাতার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটির নেতাদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে।

তবে দোহা যে শুধু হামাসের সঙ্গে সম্পর্কের হতাশার ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওয়াশিংটনের এমন দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন একজন তৃতীয় আরব কূটনীতিক। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সাময়িকভাবে কাতারের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টা বন্ধ করার পেছনে ইসরায়েলের দোষও কম নয়।

জুলাইয়ের শুরুতে হামাস তেল আবিবের মূল দাবিগুলো মেনে নেওয়ার পর, নেতানিয়াহু কীভাবে ইসরায়েলের আগের জিম্মি চুক্তির প্রস্তাবে নতুন শর্ত যুক্ত করেছিলেন, আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে এসে সেগুলো তিনি জমা দিয়েছিলেন সেদিকে নির্দেশ করেন ওই কূটনীতিক।

আরব কূটনীতিক বলেন, ‘যতবার আমরা একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর কাছাকাছি চলে গেছি, ততবারই নেতানিয়াহু নতুন নতুন শর্ত জুড়ে দিয়েছেন বা প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছেন যেটি আলোচনার গুরুত্বকে উড়িয়ে দিয়েছে।’

বাইডেনের কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, গত জুলাইয়ে আলোচনা যখন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে মোড় নিতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই হামাস এক ডজনেরও বেশি নতুন দাবি পেশ করেছিল এবং সেই শর্তের অধিকাংশই ‘অগ্রহণযোগ্য’ ছিল।

কাতার থেকে হামাস নেতাদের বহিষ্কার করা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটিকে আলোচনায় আরও নমনীয়তা দেখানোর জন্য প্ররোচিত করতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বিশ্বাস নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তৃতীয় আরব কূটনীতিক। তিনি বলেছেন, ‘এখন তারা তুরস্কে চলে গেছে এবং আমরা সেখান থেকে তাদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করছি।’ কূটনীতিক প্রশ্ন করলেন, ‘এতে কী এমন অর্জন হয়েছে?’

তবে হামাস কর্মকর্তাদের কাতার থেকে বহিষ্কার করতে বলার সিদ্ধান্তটিকে সমর্থন করেছেন বাইডেনের ওই কর্মকর্তা। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, এই পদক্ষেপটি আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল।

গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় না তুরস্ক বা তার কোনও মিত্র হামাস নেতাদের আতিথেয়তা করুক। তবে ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিকভাবে আঙ্কারাকে হামাসের সিনিয়র কর্মকর্তা খালেদ মাশালকে হস্তান্তর করতে বলেনি। খালেদ মাশাল যুক্তরাষ্ট্রে অভিযুক্ত।

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত