Homeঅর্থনীতি৩ হাজার ২০০ কোটির কাচের বাজার

৩ হাজার ২০০ কোটির কাচের বাজার


আয়না মানুষকে তার প্রতিবিম্ব দেখায়, তবে সে শুধু একটি মুখ নয়—প্রতিটি মুহূর্তের বদলে যাওয়া অস্তিত্বের ছায়া ফুটে ওঠে তাতে। তাই আয়না যেন প্রত্যেক নারীজীবনের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে না, এমন পুরুষও পৃথিবীতে খুব কম। কাচের এক পৃষ্ঠে অ্যালুমিনিয়াম বা রুপার মতো ধাতুর সূক্ষ্ম প্রলেপেই তৈরি হয় এই জাদুকরি বস্তু। মূলত কাচ একটি স্বচ্ছ, নমনীয় এবং অ-স্ফটিক নিরাকার কঠিন পদার্থ।

মানবজীবনে এর ব্যবহার শুরু হয়েছিল আয়নায় মুখ দেখার মাধ্যমে। তবে সময়ের বিবর্তনে প্রযুক্তি আর শিল্পের ছোঁয়ায় এটি পেয়েছে নতুন রূপ। একসময় কাচ নারীর জীবনে ছিল কেবল একটি আসবাব; এখন তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গভীরে প্রবেশ করে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। কাচের ব্যবহার ঘর-গৃহস্থালির অন্দরসজ্জা থেকে শুরু করে ভবনের কাঠামো পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

একসময় বাড়ির জানালা-দরজা কাঠ দিয়ে তৈরি হতো, পরে তাতে আধিপত্য বাড়ে কাচের। কিন্তু সেটিও এখন অতীত। নতুন যুগে কাচ ব্যবহৃত হচ্ছে বাড়ির দেয়াল নির্মাণেও। এই দেয়াল কেবল আলো-বাতাস প্রবাহ এবং তাপমাত্রা রক্ষায় নয়, নিরাপত্তা ও সৌন্দর্য বাড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই আজ অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ি, বাণিজ্যিক ভবন কিংবা অফিস—সব ক্ষেত্রে জানালা, দরজা, বাইরের দেয়াল এবং বিভাজক হিসেবে কাচ হয়ে উঠেছে এক অনিবার্য অনুষঙ্গ।

তা ছাড়া কাচের বহুমুখী ব্যবহার দৈনন্দিন সেবাতেও স্পষ্ট। গণপরিবহনের সাধারণ যানবাহন থেকে শুরু করে বিলাসবহুল ব্যক্তিগত এবং বাণিজ্যিক গাড়িতে মানানসই, দৃষ্টিনন্দন কাচের গ্লাস বাড়িয়েছে সৌন্দর্য ও কার্যকারিতা।

এ ছাড়া ইলেকট্রনিক পণ্য; যেমন ফ্রিজ, টেলিভিশন এবং গ্যাস স্টোভ, বাটি, ফুলদানি, ফ্রেম, বোতল, জার, পানির গ্লাস কিংবা পেপারওয়েট—কী নেই কাচের তৈরি! কালের পরিক্রমায় কাচ তার প্রয়োজনীয়তার গণ্ডি ছাড়িয়ে আলংকারিক এবং বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়েছে। আজ এই স্বচ্ছ বস্তু যেন ক্যারিশমা দেখানোর মতো মানুষের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে, সব মানুষের যাপিত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে এই কাচ।

এই ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের ছোঁয়ায় দেশের কাচশিল্প আজ এক নতুন দিকে পৌঁছে গেছে। একসময় যে কাচের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি করতে হতো, এখন সেই চাহিদার প্রায় সমান অংশই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। কাচশিল্পের এই সক্ষমতা শুধু দেশের চাহিদা পূরণেই থেমে নেই, বরং শিল্পের বিস্তারে নতুন নতুন কোম্পানির উত্থানে এর ভিত্তি আরও দৃঢ় হয়েছে।

পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির হোসেন জানান, সরকারি নীতিসহায়তার ফলে কাচশিল্পের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে, ফলে রপ্তানি বেড়েছে। দেশের চাহিদা বাড়লেও দেশীয় কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা তা পূরণে সক্ষম। বিশেষায়িত কাচও এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে এবং কাচশিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ খাতে পরিণত হয়েছে, যার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

ভবনে কাচ: আধুনিক নির্মাণের স্বচ্ছ সমাধান

ভবনে কাচের ব্যবহার জনপ্রিয় হওয়ার প্রধান কারণ এর স্বচ্ছতা। এটি ভবনের ভেতরে ধুলা প্রবেশ বন্ধ করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক আলো প্রবাহ নিশ্চিত করে। প্রথমে জানালায় ব্যবহৃত হলেও সহজলভ্যতা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে কাচ দ্রুত ভবনের বাইরের অংশের অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়েছে।

ইট বা কংক্রিটের নির্মাণে যেখানে একাধিক উপকরণ, প্রচুর অর্থ, সময় ও শ্রমের প্রয়োজন হয়, সেখানে কাচের নির্মাণ তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। ফিনিশিং ম্যাটেরিয়ালের বাড়তি ঝামেলা এড়িয়ে কেবল স্থাপন ও পরিষ্কার করলেই এটি প্রস্তুত। এই সুবিধার জন্য ব্যবসায়িক ভবনের ক্ষেত্রে কাচ বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

কাচ কীভাবে তৈরি হয়

কাচ একটি শিল্পজাত পণ্য, যা বালু গলিয়ে তৈরি করা হয়। ইসলামি কাচশিল্পীরা এই প্রক্রিয়া সহজ করেছিলেন। বর্তমানে কাচ তৈরি হয় সিলিকা, সোডা, ডলোমাইট, চুনাপাথর, ফেল্ডস্পার, সোডিয়াম নাইট্রেট ও কয়লার পাউডার মিশিয়ে। বাংলাদেশের বাজারে সাধারণ কাচ ও ক্রিস্টাল গ্লাস পাওয়া যায়, যেখানে সাধারণ কাচে সবুজাভ রং থাকে এবং ক্রিস্টাল গ্লাস একদম পরিষ্কার। গ্লাসের পুরুত্ব সাধারণত ৩ থেকে ১২ মিলিমিটার হয় এবং ভবনের বাইরে ২০ মিলিমিটার পর্যন্ত গ্লাস প্যানেল ব্যবহার করা হয়।

কাচের ধরন ও ব্যবহার

অ্যাপার্টমেন্ট ও বাণিজ্যিক স্থাপনায় সাধারণত রঙিন প্রতিফলনকারী কাচ ব্যবহৃত হয়; যা গোপনীয়তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করায়। এটি অধিক সূর্যালোক থেকে চোখ সুরক্ষা দেয় এবং জানালার পর্দার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনে। অ্যাপার্টমেন্টে ডাবল গ্লেইজড কাচ ব্যবহার করা হয়, তবে তা শুধু তাপ প্রতিরোধ করবে না, বরং এর ঘনত্বের কারণে শব্দদূষণ কমাবে এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সহায়ক হবে। একই সঙ্গে, ভঙ্গুর না হওয়ায় এটি অধিক নিরাপত্তা দেয়। লেমিনেটেড কাচ, খালি চোখে সাধারণ কাচের মতো দেখালেও ভবনের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা বাড়াতে কার্যকর। সূর্যালোক প্রতিরোধী কাচ ঘরে প্রাকৃতিক আলো প্রবেশ করিয়ে দেয়, কিন্তু সূর্যের তাপ আটকে রাখে, ফলে ঘর ঠান্ডা থাকে। শব্দ প্রতিরোধে প্রয়োজন হলে ব্যবহৃত হয় অ্যাকুস্টিক কাচ, যা পরিবেশকে শান্ত ও আরামদায়ক করে তোলে। আর ঘরকে নান্দনিক রূপ দিতে চাইলে বেছে নিতে হবে নকশাযুক্ত কাচ। এই সব ধরনের কাচ আধুনিক স্থাপত্যে কেবল কার্যকারিতা নয়, শৈল্পিকতার ছোঁয়াও এনে দেয়।

দেশে উৎপাদন সক্ষমতা

বাংলাদেশ গ্লাস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন ৬০০ টন বা ৬ লাখ বর্গফুট কাচের চাহিদা রয়েছে। আর প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে ৫০০ টন বা ৫ লাখ বর্গফুট বিভিন্ন ধরনের কাচ। একসময় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ৬টি প্রধান কারখানা—উসমানিয়া গ্লাস শিট, মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্স (এমইবি), আকিজ অ্যান্ড বশির গ্রুপ, নাসির গ্লাস, পিএইচপি ফ্লোটিং গ্লাস এবং এবি গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ কাচ উৎপাদন করত। বর্তমানে উসমানিয়া ও এমইবি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, তবে চাহিদা পূরণের জন্য চারটি কারখানায় উৎপাদিত কাচই যথেষ্ট হচ্ছে। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, দেশীয় কারখানাগুলোর মধ্যে আকিজ ও নাসির গ্রুপ প্রতিদিন ২০০ টন করে মোট ৪০০ টন কাচ উৎপাদন করে। বাকি ১০০ টন উৎপাদিত হয় পিএইচপি ফ্লোটিং গ্লাস ও এবি গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজে।

বাংলাদেশ গ্লাস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হোসেইন আলমগীর বলেন, দেশে কাচ বা গ্লাসের চাহিদা প্রতিবছর ১০-১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ গ্লাস ব্যবহৃত হয় আবাসন এবং ভবন নির্মাণে, ২০ শতাংশ শিল্প খাতের প্যাকেজিং ও আসবাব তৈরিতে, ২০ শতাংশ ফটোফ্রেম এবং অন্যান্য কাজে, আর বাকি ১০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় অন্যান্য কাজে।

বাজারের আকার

বাংলাদেশ গ্লাস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও বিক্রেতাদের সরবরাহ করা তথ্যমতে, কাচের দাম মিলিমিটার ও মান অনুযায়ী প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। যদি গড়ে ১০০ টাকা ধরা হয়, তবে দেশে প্রতিদিন উৎপাদিত কাচের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫ কোটি টাকা, যা বছরে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি। এদিকে আমদানি হওয়া কাচের মূল্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, ফলে দেশে কাচের বাজারের মোট পরিমাণ ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি।

তবু আমদানি

একসময় বাংলাদেশে কাচের পুরো বাজারই ছিল আমদানিনির্ভর। তবে দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন শুরু করার পর থেকে আমদানির পরিমাণ দ্রুত কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে দেশের কাচের চাহিদার ১৫-২০ শতাংশই আমদানি হচ্ছে, যেখানে একসময় ৯০ শতাংশ কাচ আমদানি করা হতো। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি কাচ আমদানি হয়। বিশেষত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে, যখন ১ লাখ ২১ হাজার টন কাচ আমদানি হয়েছিল। এরপর থেকেই আমদানির পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে আসছে। বর্তমানে দেশে প্রতিবছর ৩৬ হাজার টনের বেশি কাচ আমদানি হয়, যার বাজারমূল্য ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি।

বর্তমানে শিল্পপ্রতিষ্ঠানই বেশি কাচ আমদানি করছে, বিশেষত ইলেকট্রনিক পণ্য ও গাড়ির জন্য। অধিকাংশ কাচ আসে চীন থেকে এবং কিছুটা আমদানি হয় তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে। তবে উদ্যোক্তারা আশা করছেন, ভবিষ্যতে এসব কাচের আমদানিনির্ভরতা কমবে।

হচ্ছে রপ্তানিও

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৮ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের গ্লাস রপ্তানি হয়, যা ২০০৫ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। তবে চলতি বছরের প্রথমার্ধে রপ্তানি ৩৭ শতাংশ কমেছে এবং ডিসেম্বরে এটি প্রায় ৬৪ শতাংশ কমেছে। ২০০৫ সালে পিএইচপি পরিবার রপ্তানি শুরু করে, কিন্তু বর্তমানে নাসির ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ শীর্ষে রয়েছে। ২০২৩-২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের গ্লাস রপ্তানি হয়েছে, যা ২০২৪-২৫ সালে ৩ দশমিক ১০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। রপ্তানির ৭২ শতাংশ ভারত ও নেপালে যায়। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও আফ্রিকার কিছু দেশে; যেমন উগান্ডা, তানজানিয়া ও কেনিয়ায়ও রপ্তানি হচ্ছে। নতুন বাজার হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতও যুক্ত হয়েছে।

বাড়ছে বিনিয়োগ সম্ভাবনা

দেশে গ্লাস বাজারে প্রবেশের জন্য প্রাণ-আরএফএলসহ আরও বড় কোম্পানিগুলোর আগ্রহ রয়েছে। তারা এরই মধ্যে টেম্পার্ড গ্লাস তৈরি করছে, বিশেষ করে আসবাব ও ইলেকট্রনিক পণ্যের জন্য। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, প্রাণ-আরএফএল টেম্পার্ড গ্লাস তৈরি করছে আসবাব ও ইলেকট্রনিক পণ্যের জন্য। ইলেকট্রনিক পণ্যে এর চাহিদা বাড়ছে, তাই আমরা বিনিয়োগ সম্প্রসারণ করতে চাই। এ ছাড়া ফ্লোট গ্লাস তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে আমাদের, যা কিছু কারণে একটু পিছিয়ে গেছে।

আছে চ্যালেঞ্জ

কাচশিল্পে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ১২-১৫ বছর ধরে উৎপাদন চালু রাখা। যদি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, তবে চুল্লি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং নতুন বিনিয়োগ করতে হবে। এ জন্য কারখানায় তিন থেকে ছয় মাসের কাঁচামাল মজুত রাখতে হয়। দেশে সিলিকা বালু ছাড়া সব কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এ কারণে উৎপাদন খরচ বেশি। বিনিয়োগ ঝুঁকিও বেশি। তবে চীনে কাঁচামাল সহজলভ্য, তাই তারা কম সময় মজুত রাখে এবং উৎপাদন ব্যয়ও তাদের কম হয়।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত