বিটকয়েন নিয়ে সংশয় সব সময়ই ছিল। আধুনিক অর্থকড়ির জনক হিসেবে পরিচিত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ইউজিন ফামা কয়েক দিন আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিটকয়েন একেবারেই মূল্যহীন হয়ে যাবে। তাঁর এই মন্তব্য বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু এরপরও বিটকয়েনের নতুন নতুন রেকর্ড গড়া বন্ধ নেই। বিটকয়েনের এই উত্থানের পেছনে কি ট্রাম্পের ক্ষমতারোহণ কাজ করছে?
২০২৪ সালের নভেম্বরে বিটকয়েন প্রথমবারের মতো ১ লাখ ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। ধারণা করা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্রিপ্টোবান্ধব নীতির কারণে বাজারে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল। এরপর গত ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার আগেই বিটকয়েন সর্বোচ্চ ১ লাখ ৯ হাজার ২৪১ ডলারে পৌঁছে যায়।
ক্রিপ্টো মুদ্রার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখানো ট্রাম্প এরই মধ্যে ডিজিটাল ডলারের বিপরীতে স্থিতিশীল ক্রিপ্টো কয়েনকে (স্টেবল কয়েন) সমর্থন দিয়েছেন এবং কৌশলগত বিটকয়েন রিজার্ভ গঠনেরও প্রস্তাব দিয়েছেন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) সকাল ৭টা ৪৭ মিনিট (জিএমটি) পর্যন্ত বিটকয়েনের দাম ছিল ৯৭ হাজার ১৮৬ ডলার।
ফামা কেন বিটকয়েন ধসে যাওয়ার কথা বলছেন?
যখন ক্রিপ্টো সমর্থকেরা বিটকয়েনের দাম গগন স্পর্শের আশা করছেন, তখন ফামা এর বিপরীত মত দিয়েছেন। আধুনিক অর্থনীতির এই পথিকৃৎ মনে করেন, বিটকয়েনের প্রধান ত্রুটিগুলোই একসময় এর পতনের কারণ হবে। এর মধ্যে রয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত অস্থিরতা—দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য এটি নির্ভরযোগ্য নয়। কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেই—প্রচলিত মুদ্রার মতো এটি কোনো সরকার বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে নয়। শুধু চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। সেই চাহিদা কমে গেলে মূল্য শূন্যে নেমে আসবে। প্রকৃত মুদ্রা নয়—যদি এটি ব্যাপকভাবে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত না হয়, তাহলে এটি কি সত্যিকারের মুদ্রা?
বিটকয়েন কি ডিজিটাল স্বর্ণ?
ফামার বক্তব্যের বিরোধিতা করে সমর্থকেরা বলছেন, বিটকয়েন শুধু মুদ্রা নয়, এটি এখন ‘ডিজিটাল স্বর্ণ’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এমনটি বলার কারণ কয়েনটির সীমিত সরবরাহ। বর্তমানে ক্রিপ্টো বাজারে বিটকয়েনের মোট সরবরাহ ২১ মিলিয়নের বেশি হবে না। এর ফলে এটি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে, যা মূল্য বাড়ানোর অন্যতম কারণ।
মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবমুক্ত—প্রচলিত মুদ্রার বিপরীতে বিটকয়েনের সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ নেই। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকার এটিকে অতি মুদ্রার মাধ্যমে অবমূল্যায়িত করতে পারবে না। অর্থনৈতিক সংকটের সময় এটি একটি বিকল্প বিনিয়োগের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।
তবে সমালোচকেরা মনে করেন, বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত এবং বাজারের মনোভাবের ওপর বিটকয়েনের মূল্য নির্ভর করে। ফলে এটি পুরোপুরি মুক্তবাজারের প্রভাবমুক্ত নয়।
কী হলে বিটকয়েন ধ্বংস হতে পারে?
বিটকয়েনের টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা। যদি বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো বিটকয়েন লেনদেন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে, তাহলে এর বাজার ধসে পড়তে পারে।
এরপর রয়েছে প্রযুক্তিগত ত্রুটি। যদি বিটকয়েনের প্রযুক্তিতে কোনো গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়, তবে এটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এরপর রয়েছে উন্নত প্রযুক্তির বিকল্প মুদ্রার আবির্ভাব। যদি বিটকয়েনের চেয়ে বেশি কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য একটি ক্রিপ্টো মুদ্রা আসে, তাহলে বিনিয়োগকারীরা বিটকয়েন থেকে সরে যেতে পারেন।
বিটকয়েনের ‘দুষ্প্রাপ্যতা’ সত্য নাকি মিথ?
কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বিটকয়েনের সীমিত সরবরাহ আসলে অর্থহীন। অর্থনীতিবিদ পিটার শিফ দাবি করেন, যে কেউ ইচ্ছা করলে স্বল্প খরচে একটি নতুন মুদ্রা তৈরি করতে পারে, যার সরবরাহও নির্দিষ্ট থাকবে। ফলে ডিজিটাল মুদ্রার ‘দুষ্প্রাপ্যতা’ নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
বিটকয়েনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিতর্ক থামছে না। ফামা ও শিফের মতো বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এটি ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্যদিকে সমর্থকেরা একে অর্থনীতিতে বিপ্লব হিসেবে দেখছেন।
একটি বিষয় নিশ্চিত, বিটকয়েন এবং অন্যান্য ক্রিপ্টো মুদ্রা এখনো বিবর্তনের পথে। এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে গ্রহণযোগ্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও বাজার পরিস্থিতির ওপর।