আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের ওপর আর কর বাড়ানো হবে না বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। আজ বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে আয়োজিত প্রাক-বাজেট আলোচনায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
এদিন আলোচনায় অংশ নিয়ে মোবাইল, সিগারেট, বিড়িশিল্পের মতো বৃহৎ করদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরে। এর জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, সিগারেটের ওপর আর কর বাড়ানো হবে না।
অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ–আমেরিকান টোব্যাকোর হেড অব করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স শাবাব চৌধুরী বলেন, সিগারেটের ওপর কর ও দাম বাড়ালে অপরাধীরা সুযোগ নেয়। চোরাকারবারের সুযোগ বাড়ে। এতে সরকার রাজস্ববঞ্চিত হয়।
শাবাব চৌধুরী বলেন, ‘রাজস্বের ৮৮ ভাগ আমাদের। আমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করা উচিত। দাম আর বাড়াইয়েন না, করও বাড়াইয়েন না। ভোক্তাকে স্থির হতে দেন। নইলে চোরাচালান বাড়বে।’
বাংলাদেশ বিড়ি শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ মহিউদ্দিন বলেন, এ শিল্পে দেশের বিভিন্ন জেলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ১৮ লক্ষাধিক শ্রমিক জড়িত। বিশেষ করে, দেশের সুবিধাবঞ্চিত, অসহায়, স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা, শারীরিক প্রতিবন্ধী, গরিব, হতদরিদ্র, দিনমজুর, নদীভাঙন ও চর এলাকার স্বল্প আয়ের মানুষের জীবিকা বিড়িশিল্পের ওপর নির্ভর করে।
শেখ মহিউদ্দিন বলেন, ‘বিড়িতে মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক ও কর বাড়ানোর ফলে এই শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। তাই বিড়িশিল্প ও শ্রমিকদের রক্ষার্থে চলতি বাজেটেও এ শিল্পের ওপর আরোপিত শুল্ক না বাড়ানোর আহ্বান জানাই।’
বিড়ি শিল্প মালিক সমিতি বলছে, শুধু বিড়ির করহার ১০ শতাংশ, যা বর্তমানে সমন্বয়যোগ্য নয়। অন্যদিকে ধারা-১৫২ অনুযায়ী সিগারেটের ওপর করহার ৩ শতাংশ, যা সমন্বয়যোগ্য। এ ক্ষেত্রে সিগারেটের সঙ্গে বিড়ির ক্ষেত্রেও ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করছি। এতে উভয় খাতের বিদ্যমান করবৈষম্য দূর হবে। এ ছাড়া বিড়ির ট্যারিফ মূল্য কমানোর প্রস্তাব করেছে সংগঠনটি।
দেশে সিগারেটের চেয়ে বিড়ির ট্যাক্স কম উল্লেখ করে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, নকল বিড়ির উৎপাদন বন্ধ না করলে বিড়ি মালিক শিল্প সমিতির বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আবদুর রহমান খান বলেন, ভ্যাট থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আসার কথা, তা আসে না। ভোক্তা ভ্যাট দিয়ে রিসিট না নিলে রাজস্ব বাড়বে না। যাঁরা ভ্যাট দিয়ে রিসিট নেবেন, তাঁদের লটারির মাধ্যমে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার দেওয়া হবে। সে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল অপারেটরস অব বাংলাদেশের (এমটব) মহাসচিব লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, ‘একটি জরুরি সেবা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের মোবাইল শিল্পকে খাতওয়ারি কর দিতে হয় এবং বৈশ্বিক বিবেচনায় আমরা সবচেয়ে বেশি কর দিই। সরকার প্রায় প্রতিবছর এই খাতে কর বাড়িয়ে আসছে, যার বিরূপ প্রভাব গ্রাহকদের ওপর পড়ছে।’
মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, কর বাড়ানোর কারণে গত বছরের মাঝামাঝি থেকে দেশে মোবাইল ও ইন্টারনেট গ্রাহক আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে।
মোবাইল সিমের ওপর ধার্য করা ৩০০ টাকার ভ্যাট অব্যাহতি চেয়েছে এমটব। মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, সিম সরবরাহের ওপর হতে মূল্য সংযোজন কর অপসারণ করা হলে গ্রামাঞ্চলে মোবাইল সম্প্রসারণে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, কার্যত যা সরকারের সমগ্র বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনার লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
দ্বৈতকর এড়ানোর বিষয়ে এমটবের মহাসচিব বলেন, ‘রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ (পিএসআর) দাখিলে ব্যর্থ হলে আয়কর আইন অনুযায়ী ৫০ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর আরোপের বিধান রয়েছে। এতে একই খরচের ওপরে দ্বৈতকর আরোপ করা হয়, যা আয়কর আইনের মূলনীতি পরিপন্থী। এই নীতি পরিহার করার অনুরোধ করছি।’
মোবাইল খাতের করপোরেট কর অনেক বেশি উল্লেখ করে জুলফিকার বলেন, ‘বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মোবাইল অপারেটরদের করপোরেট করহার ৪০ শতাংশ ও তালিকা না হওয়া কোম্পানির জন্য ৪৫ শতাংশ। কিন্তু অন্য খাতের কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি যথাক্রমে সাড়ে ২৭ ও ২০ শতাংশ। মোবাইল অপারেটরদের পৃথক শ্রেণিভুক্ত না করে অন্যান্য কোম্পানির সারিতে পুনর্বিন্যস্ত করা হোক। আর তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর কমানোর প্রস্তাব করছি।’
লিখিত প্রস্তাবনায় বাংলাদেশ ঔষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি আব্দুল মুক্তাদির বলেন, ‘আমদানি করা পণ্যের এইচএস কোড নির্ধারণে অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমদানিকারকদের ২০০-৪০০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করা হয়ে থাকে। বিনা জরিমানায় এইচএস কোড নির্ধারণে কাস্টমস আইনের সংশোধন প্রয়োজন।’
আব্দুল মুক্তাদির বলেন, ‘কেমিস্টদের বিক্রি করা টাকা দিনশেষে কোনো ব্যাংকিং ও নগদ অর্থের নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকায় তা কোম্পানিগুলোকে নগদে নিতে বাধ্য করে থাকে। তাই ঔষধশিল্পের ব্যবসার প্রকৃতি বিবেচনা নিয়ে প্রত্যেক আয়বর্ষে সব প্রকার আয় ও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করছি।’
ঔষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি আরও বলেন, ‘ঔষধশিল্পের প্রকৃতির কারণে প্রত্যেক একক লেনদেন ৫ লাখ টাকার অধিক ও বার্ষিক সর্বমোট ৩৬ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে সব প্রকার ব্যয় ও বিনিয়োগ ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। তাই এই শিল্প খাতের ব্যয়ের ক্ষেত্রে মোট ব্যয়ের ২০ শতাংশ নগদ লেনদেনের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করছি।’
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) ক্লিংকারের ওপর কাস্টমস ডিউটি (সিডি) কমিয়ে প্রতি টনে ২০০ টাকা করার সুপারিশ করেছে। শুল্ক কমানোর যুক্তি হিসেবে সংগঠনটি বলছে, কোনো শিল্পের প্রধান কাঁচামালের ওপর কাস্টমস ডিউটি সাধারণত আমদানিমূল্যের ওপর প্রায় ৫ শতাংশ হয়, কিন্তু ক্লিংকারের ওপর প্রতি টনে ৭০০ টাকা আদায় করার ফলে কাস্টমস ডিউটি দাঁড়ায় আমদানিমূল্যের প্রায় ১৫ শতাংশ।
বিষয়টি সিমেন্ট শিল্পমালিকদের কাছে অসামঞ্জস্য বলে মনে হচ্ছে উল্লেখ করে বিসিএমএ বলছে, এর ক্ষতিকর প্রভাব সিমেন্টের বাজারে ভোক্তাসাধারণের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। সার্বিক নির্মাণ কার্যক্রমে গতি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর ৩ শতাংশ ন্যূনতম কর আরোপিত রয়েছে, যা কমিয়ে দশমিক ৬ শতাংশ করার আহ্বান খাতসংশ্লিষ্টদের। এ ছাড়া এ খাতে সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ ও মিনারেল ওয়াটারে সম্পূর্ণ শুল্ক অব্যাহতির দাবি জানানো হয়।
ব্যবসায়ীদের দাবির জবাবে ব্যবসাবান্ধব করব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে চান বলে জানান এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায় বাধা তৈরি করে ও খরচ বাড়ায়, এমন বিধান সংশোধন করা হবে। কমিয়ে আনা হবে অযৌক্তিক উৎসে করের চাপ। আমরা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে চাই।’
আবদুর রহমান আরও বলেন, ‘এখন অনেক ক্ষেত্রে করের হার অনেক বেশি। আমরা এটা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে চাই।’
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘এবারের বাজেটে আপনারা এর একটি প্রতিফলন দেখতে পাবেন।’
প্রাক-বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান ছাড়া আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগের নীতি শাখার সদস্য ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।