আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক খাতে লুটপাট হয়েছে। ঋণের নামে হয়েছে ব্যাংকের টাকা ভাগাভাগি। অর্থ পাচারের রেকর্ড হয়েছে। কারও মুখ খোলার মতো অবস্থা ছিল না। গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে সবকিছু। আর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে ব্যাংক খাতে সংস্কারে মনোযোগ দেয়। এতে গত ছয় মাসে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরেছে ব্যাংক খাতে।
খাদের কিনারে পড়ে যাওয়া ব্যাংক খাতকে উদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া উদ্যোগের অংশ হিসেবে এস আলমের মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংকসহ ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়, যাতে গ্রাহকের মধ্যে কিছুটা আস্থা ফিরে আসে। কিন্তু কয়েকটি ব্যাংকে পর্ষদ কাজ করছে না। আবার ইসলামী ব্যাংকের এস আলমের লুটের সহকারী এমডি মুহাম্মদ মনিরুল মওলা এবং চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে নিয়ে বিক্ষোভ গতকাল পর্যন্ত চলমান ছিল।
এস আলমের লোকজন সক্রিয় থাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত মে মাসে ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করে। এতে সুদের হার মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এতে বিনিয়োগ হ্রাস পায়। আবার একই সময়ে ডলার কেনাবেচায় ‘ক্রলিং পেগ’ ব্যবস্থা চালু করে। ব্যাংকগুলোকে ১১০ টাকার ডলার প্রায় ১১৭ টাকায় বিক্রির কথা জানায়। এভাবে বাড়তে বাড়তে ডলারের দর ১২২ টাকায় গিয়ে ঠেকে। গতকাল ব্যাংকে প্রতি ডলারের ঘোষিত দর ছিল ১২১ টাকা ৯১ পয়সা, যা খোলাবাজারে ছিল ১২৭ টাকা। আর গত মাসে রেকর্ড ১৩১ টাকায় ওঠে ডলারের বিনিময়মূল্য।
আওয়ামী লীগের আমলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য গোপন করা হতো। অন্তর্বর্তী সরকার সেই গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে। গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ফরেনসিক অডিট করছে। পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। মূলত এস আলম, বেক্সিমকো, সামিট, বসুন্ধরা, জেমকন, ওরিয়ন, নাবিল, নাসা, সিকদার ও আরামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও অন্যান্য আর্থিক জালিয়াতি তদন্তে সরকারি টাস্কফোর্স বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ জন্য বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ইসলামী ব্যাংকসহ এস আলম গ্রুপের মালিকানায় থাকা ব্যাংকগুলোয় যে ভঙ্গুর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার বিস্তৃতি কতটা, তা জানতে নিরীক্ষা দরকার। এর ভিত্তিতে ঠিক করতে হবে, এসব ব্যাংকের সংস্কার কীভাবে হবে এবং শেষ পর্যন্ত এগুলোর দায়দায়িত্ব কার ওপর দেওয়া হবে। ব্যাংক খাত থেকে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা ভাগিয়ে নিয়েছে কয়েকটি গ্রুপ, যা অধিকাংশ পাচার হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে।
ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে বিএফআইইউর প্রধানকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দোষী ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এস আলম, সালমান এফ রহমানসহ সন্দেহভাজন প্রায় ১০ হাজার হিসাব জব্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত লকার জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ব্যাংক খাতে অনেক অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে। কিছু ব্যাংক দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। সব মিলে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরে আনতে চেষ্টা করা হচ্ছে। অনিয়ম অনুসন্ধান ও সংকট উত্তরণে সুপারিশ করবে সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো। পরে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এসব হতে সময় লাগবে।