দেশের সিরামিক শিল্প চরম সংকটে। গ্যাস-সংকট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং উৎপাদন ব্যয়ের চাপ শিল্পটিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। গ্যাসের সরবরাহ নেই, ফলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একের পর এক অর্ডার বাতিল হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমছে। এক বছর ধরে এই খাত চরম দুরবস্থার মধ্যে আছে। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলার অবনতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এখনো কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। আগে থেকেই শিল্পটি শুল্কের বোঝা বইছে। তদুপরি টাইলস ও সিরামিক পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে ১০-১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়েছে, যা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। যদি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় এবং গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক না হয়, তাহলে পুরো শিল্প রুগ্ণ হয়ে পড়বে।
শিল্পমালিকদের দাবি, তাঁরা একের পর এক ইউনিট বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক কারখানা তাদের উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম না বাড়ানো এবং সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
‘গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহার, সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং সিরামিক পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক বাতিলের দাবিতে খাতটির সংগঠন বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উঠে আসে এসব কথাবার্তা।
গতকাল সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিসিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মইনুল ইসলাম, উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাছির হোসেন এবং সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মামুনুর রশীদ বক্তব্য দেন। এ সময় বিসিএমইএর সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন, সহসভাপতি আবদুল হাকিম এবং পরিচালক রাশীদ মাইমুনুল ইসলাম, ফারিয়ান ইউসুফসহ সংগঠনের সদস্য উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মইনুল ইসলাম বলেন, ‘সিরামিক শিল্প দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত। ১৯৮৩ সালে এর যাত্রা শুরু হলেও নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে উদ্যোক্তারা এটি দাঁড় করিয়েছেন। বর্তমানে ৮০টির বেশি সিরামিক, টেবিলওয়্যার, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার কারখানা চালু রয়েছে, যা দেশীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখছে। এতে বছরে অন্তত ২ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হচ্ছে। কিন্তু গ্যাস-সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি এ শিল্পের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করছে।’
মইনুল ইসলাম বলেন, গ্যাস-সংকটের কারণে পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানির অর্ডার বাতিল হচ্ছে। নিবন্ধিত ৫০টির বেশি সিরামিক কোম্পানি নতুন বিনিয়োগ স্থগিত রেখেছে। পাঁচটি নতুন কারখানা শুধু গ্যাসের স্বল্পতার কারণে উৎপাদন শুরু করতে পারছে না।
মইনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, যা শিল্পের জন্য আরও বড় ধাক্কা হবে। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে গ্যাসের মূল্য ৩৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে সিরামিক পণ্যের উৎপাদন ব্যয় ১৮-২০ শতাংশ বেড়েছিল। এখন নতুন করে দাম বাড়ালে উৎপাদন ব্যয় আরও ৩০-৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সরকারের শিল্পবান্ধব নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমরা সরকারকে এই ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে সম্প্রতি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে।
মীর নাছির হোসেন বলেন, ‘সিরামিক পণ্য বিলাসিতা নয়, এটি অপরিহার্য। এই শিল্প বন্ধ হলে দেশ আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও গ্যাস-সংকট আমাদের চরম বিপদে ফেলছে। নতুন সংযোগ নিলে গ্যাসের খরচ বেশি হবে, ফলে নতুন উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না। পুরোনো কারখানাগুলোরও প্রসার সম্ভব হবে না।’
মীর নাছির হোসেন আরও বলেন, উৎপাদন ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে দেশের শিল্প খাত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। সরকারের উচিত গ্যাস চুরি রোধ করা, যাতে খরচ কমে এবং দাম বাড়ানোর প্রয়োজন না হয়।
মামুনুর রশীদ বলেন, একসময় বাংলাদেশ চীন ও শ্রীলঙ্কা থেকে সিরামিক পণ্য আমদানি করত। কিন্তু এখন দেশেই বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। অথচ গ্যাস-সংকটের কারণে ইতিমধ্যে খাতটির ২০-২৫টি কারখানা বন্ধের পথে। বাকিরা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন যেখানে ১২ হাজার বর্গফুট উৎপাদন করা সম্ভব, সেখানে এখন মাত্র ৬-৭ হাজার বর্গফুট হচ্ছে।
শিল্পমালিকেরা সরকারের কাছে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন—গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে, শুল্ক বাতিল করতে হবে। তা না হলে সিরামিক শিল্প সংকুচিত হবে, শ্রমিক ছাঁটাই বাড়বে, রপ্তানি হ্রাস পাবে, ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়বে এবং সরকারও রাজস্ব হারাবে। সংকট সমাধানে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।