দেশের কর জিডিপি রেশিও দীর্ঘদিন ধরে ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে এবং গত অর্থবছরে এটি ৮ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, কর আহরণে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত, ফলে পুরো প্রক্রিয়া স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতার দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, করদাতাদের আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব বড় এক বাধা। কারণ অনেকেই মনে করেন, তাঁদের পরিশোধিত কর যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। তৃতীয়ত, কর আদায়ে দুর্নীতি এবং কার্যকর পদ্ধতির অভাব প্রক্রিয়াটি আরও জটিল করেছে। পাশাপাশি করের আওতায় আসা উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা খুবই কম, যা রাজস্ব সংগ্রহে বাধা সৃষ্টি করছে। ভ্যাট ও শুল্কের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা আয়কর বা ইনকাম ট্যাক্সের তুলনায়, কর জিডিপি কম হওয়ার একটি বড় কারণ, যা সুষম রাজস্ব প্রবাহের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
গতকাল শনিবার রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক কর্মশালায় মূল প্রবন্ধে কর জিডিপি বাড়ানোর চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর এভাবেই আলোকপাত করা হয়। কর্মশালায় র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ড. এম আবু ইউসুফ ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য দেশীয় রাজস্ব সংগ্রহ: বাংলাদেশের জন্য নীতি-সংস্কার অগ্রাধিকার’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন। ওই প্রবন্ধে তিনি কর ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল করার জন্য ডিজিটালাইজেশনের পাশাপাশি কিছু কার্যকর সুপারিশও তুলে ধরেন। রাজধানীর ইআরএফ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান।
আবু ইউসুফ তাঁর মূল প্রবন্ধে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে সমন্বিত কর রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব দেন, যেখানে জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ট্যাক্স সিস্টেম যুক্ত থাকবে। তিনি এসএমই এবং গ্রামাঞ্চলের করদাতাদের অন্তর্ভুক্ত করতে দেশব্যাপী ক্যাম্পেইনের সুপারিশ করেন। কর ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন, শক্তিশালী অডিট ব্যবস্থা এবং উৎসে করের সমন্বয় বাড়ানোরও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য বাস্তবসম্মত হওয়া জরুরি এবং সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য তার কারণ এবং যথার্থতা স্পষ্ট হওয়া উচিত।
আবু ইউসুফ আরও জানান, করদাতারা যখন দেখেন তাঁদের টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে না এবং দুর্নীতি চলছে, তখন তাঁরা কর দিতে উৎসাহী হন না। তাই সুনিশ্চিত ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে এবং দুর্নীতি কমাতে হবে। এ ছাড়া ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে কর আদায়কে সহজ এবং কার্যকর করতে হবে, যাতে করদাতা ও আদায়কারীর সাক্ষাৎ কমিয়ে দুর্নীতি হ্রাস পায়।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, পূর্ববর্তী বাজেটগুলো ছিল উচ্চাভিলাষী। ফলে বাজেটের আকার বাড়ানোর সঙ্গে বরাদ্দও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দুর্নীতি বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, যারা রিটার্ন জমা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ১০ লাখ টাকার আয় থাকলেও সাড়ে তিন লাখ টাকার কম আয়কর পরিশোধ করেছেন—তাঁরা শুধু রিটার্ন জমা দিলেও কর দেননি।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা করের হার আদর্শ হারের কাছাকাছি নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করছি, এবং আসন্ন বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ বাতিল করার পরিকল্পনা রয়েছে। যদি তা পুরোপুরি বাতিল করা সম্ভব না হয়, তবে আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত অর্থের ওপর করের হার বাড়ানো হবে। তিনি আরও বলেন, ‘যদি কালোটাকা সাদা করার সুযোগ পুরোপুরি বাতিল করতে না পারি, তবে অন্তত বিদ্যমান করের হার বাড়িয়ে আদর্শ হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য করব।’ বর্তমানে রিয়েল এস্টেট খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করের হার আদর্শ হারের চেয়ে কম, যা নিয়ে আলোচনা রয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, সম্প্রতি অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের কিছু সুবিধা বাতিল করা হয়েছে এবং সানসেট ক্লজের অধীনে আগামী জুনে এ সুবিধাগুলো শেষ হবে। বর্তমানে ব্যক্তিগত করদাতাদের জন্য সর্বোচ্চ করের হার ২৫ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রথম আলোর অনলাইন বিভাগের প্রধান শওকত হোসেন মাসুম। তিনি বলেন, ‘বড় করদাতাদের মধ্যে অনেকেই কর পরিশোধ করেন না এবং তাঁদের করের আওতায় আনতে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এতে কর আদায়ে চাপ পড়ে কেবল তাঁদের ওপর, যাঁরা নিয়মিত কর দেন। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যেভাবে ভ্যাট এবং শুল্কের মাধ্যমে পরোক্ষ করের ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে, তাতে পরিবর্তন এনে সরাসরি কর বা আয়ের ওপর কর আরোপ করা উচিত।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম এবং সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আক্তার মালা।