Homeঅর্থনীতিভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধির প্রভাব বাজারে, চাপে সাধারণ মানুষ

ভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধির প্রভাব বাজারে, চাপে সাধারণ মানুষ


বছরের শুরুতেই একদিকে বৃদ্ধি পায় বাড়ি ভাড়া। অপরদিকে চাপ থাকে সন্তানকে স্কুলের নতুন ক্লাসে ভর্তি করার। এই দুই চাপ সামলে উঠতে না উঠতেই এবছর পড়তে হয় আরেক ধাক্কায়। চলতি বছরের শুরুতে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়ে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। উপদেষ্টারা সে সময় বলেছিলেন, কর বাড়ানো হলেও মানুষের ওপর খুব বেশি চাপ তৈরি হবে না। যদিও সাধারণ মানুষ ও অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা সত্যি করে ফল হয়েছে উল্টো। এমনকি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও সম্প্রতি একথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে মানুষ চাপে পড়ছে। বিষয়টি অনুভব করলেও কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে এটি করতে হয়েছে।’ এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ মানুষ। তবে আগামী বাজেটে ভ্যাটের বিষয়টি সংশোধন করা হবে, বলছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের আগে থেকেই, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন ঘটেছে। কখনও খাদ্যে, কখনও খাদ্যবহির্ভূত খাতে, কখনও আবার সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়েছে দুই অঙ্কের ঘর। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়েও ওষুধ, এলপি গ্যাস, মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবাসহ ৬৭ পণ্য ও সেবায় শুল্ক, কর, ভ্যাট বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। নতুন বছরের স্বাভাবিক চাপের মধ্যে এমন সিদ্ধান্তে হতাশার কথা জানিয়েছেল অনেকেই। এক মাস যেতে না যেতেই তাদের আশ্বাসের উল্টো ফল হতে শুরু করায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায় দুই সন্তান ও পরিবার নিয়ে বসবাস করেন কামরুজ্জামান। কাজ করেন একটি বেকারি ফ্যাক্টরিতে। দুই সন্তানই স্কুলে পড়ে। বছরের শুরুতেই দুই সন্তানকে নতুন ক্লাসে ভর্তি বাবদ গুণতে হয়েছে ৭ হাজার টাকা। তার বাসা ভাড়াও বেড়েছে ৬০০ টাকা। এর মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর ভ্যাট বাড়ানোর কারণে বেড়েছে অন্যান্য পণ্যের দাম। বিপরীতে তার পারিশ্রমিক বাড়েনি এক টাকাও। এ নিয়ে অনেকটাই চাপে আছেন কামরুজ্জামান।

একই অবস্থা সরকারি কর্মচারী গোলাম রসুলেরও, তিনি কাজ করেন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের একটি সরকারি দফতরে। পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন গ্রিন রোড সরকারি কোয়ার্টারে। নাম জানালেও নিরাপত্তার কারণে দফতরের নাম প্রকাশ করতে আপত্তি তার। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজের ভর্তির ফি’র বাড়তি টাকা জোগাড় করতে গিয়ে একটা চাপ অনুভব করি। এর ওপর সরকার একই সময় বাড়িয়েছে বিভিন্ন পণ্যের ভ্যাট-ট্যাক্স।’

তার ভাষ্য, ‘সরকার যখন ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ায়, তখন তা ওই নির্দিষ্ট পণ্যের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকে না। ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে সব পণ্যের দাম বাড়ায়। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমাদের। আমরা যারা কম বেতনের চাকরি করি, আমাদের কষ্ট হচ্ছে। বেশি বেতনের কর্মকর্তারা তো খোঁজই রাখেন না, কখন কোন পণ্যের দাম বাড়লো বা কমলো। কারণ তারা তো বাজারেই যান না।’

এমন পরিস্থিতি শুধু কামরুজ্জামান বা গোলাম রসুলেই নয়। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন দেশের বেশিরভাগ  নিম্নআয়ের মানুষ। বাড়তি ভ্যাটের প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন পণ্যের বাজারে। দাম বেড়েছে আমদানি করা ফল, তৈরি পোশাক, বিস্কুট, জুস ও টিস্যুর। চাল ডাল তেলের দাম তো আগেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এতে অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। আর ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কায় আছেন উদ্যোক্তারা। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে ভ্যাটের হার পুনর্বিবেচনার আহ্বান অনেকের। তারা তাগিদ দিয়েছেন— ভ্যাট না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানোর ওপর। এমন অবস্থা স্বল্প আয়ের সব মানুষের। জীবনযাপনের ব্যয়ের সঙ্গে তারা আর পাল্লা দিতে পারছে না। দ্রব্যমূল্যের চাপে দিশেহারা সবাই।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সঙ্গে বাড়ছে শিক্ষার ব্যয়ও। নতুন বছরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি ফি ও বেতন বাড়ানোর কারণে বিকল্প ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা। রাজধানীর নীলক্ষেতের স্টেশনারি দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জানুয়ারি মাসকে কেন্দ্র করে প্রতিটি শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ানো হয়েছে। শুধু কাগজের দাম স্থিতিশীল আছে। তবে করোনার মধ্যে কাগজের দামও দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছিল। এ ছাড়া কলম, পেনসিল, রাবার, স্কেল, রঙ পেনসিল, স্ট্যাপলার, পিন, স্কুলের ব্যাগসহ সব ধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম নতুন বছরে ১০ শতাংশ করে বেড়েছে। নতুন বছরের প্রতিটি শ্রেণির গাইড বইয়ের দামও দ্বিগুণ হয়েছে।

গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মানুষ খরচ কাটছাঁট করছে। এরফলে পুষ্টি চাহিদাও মেটানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির শিকার।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে ৬৮ শতাংশ মানুষ। নিম্নআয়ের পরিবারগুলো খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং আয় কমে যাওয়ায় নানাভাবে সাশ্রয়ের চেষ্টা করছে। উদাহরণ তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ আলু খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছে।

বছরের শুরুর দিকে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় উপদেষ্টারা বলেছিলেন, কর বাড়ানো হলেও মানুষের ওপর খুব বেশি চাপ তৈরি হবে না। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তারা বলেছিলেন, বিভিন্ন নিত্যপণ্যে আগে থেকেই শুল্ক-কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের এই যুক্তির বিপরীতে অর্থনীতিবিদরা বলছিলেন, চড়া মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির মধ্যে শুল্ক-কর বাড়ানো ঠিক হয়নি। আগামী বাজেট পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতো। বরং ধনীদের ওপর কর বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ওপরও জোর দেওয়া দরকার বলেও মনে করেন তারা।

অবশ্য সিদ্ধান্তের মাসখানেক সময় যেতে না যেতেই সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও উপলব্ধি করছেন ভ্যাট বাড়ানোর কারণে সাধারণ মানুষ চাপে পড়ছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি জানিয়েছেন, ভ্যাট বাড়ানোর তুলনায় আরও বেশি হারে দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেছেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবে যতটা না ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, ব্যবসায়ীরা তার চেয়ে বেশি হারে দাম বাড়াচ্ছেন।’ এ ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে মানুষ চাপে পড়ছে— এ বিষয়টি অনুভব করলেও ‘কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে’ এটি করতে হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন অর্থ উপদেষ্টা।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত ২৫ বছরে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। বাড়ি ভাড়া বেড়েছে গড়ে ১০ শতাংশ। এর মধ্যে বস্তির ঘর ভাড়া বেড়েছে ১১ শতাংশ এবং মেস রুমের ভাড়া গড়ে বেড়েছে ৮ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, যেসব পণ্যে ট্যাক্স বেড়েছে, সেগুলোর দাম তো বাড়বে। ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) অনুযায়ী, এসব পণ্যের ওজন কম, দর কম; সেজন্য হয়ত মূল্যস্ফীতির হারের ওপর প্রভাব খুব কম পড়বে। যেসব পণ্যের দাম বাড়ানো হলো, বেশিরভাগ পণ্যের ক্ষেত্রে যেগুলো ১৫ শতাংশের নিচে ছিল, সেগুলোকে ১৫ শতাংশে ওঠানো হয়েছে। তার মানে ভ্যাট রেট ইউনিফিকেশন (একীভূতকরণ), মানে সব পণ্যে একই ভ্যাট হবে, এটা তো একটা নীতি ছিল সরকারের।

তবে এই শুল্ক ও কর বাড়ানোর জন্য এই সময়টাকে যথোপযুক্ত মনে করছেন না তিনি। কাজটি বাজেটেই করা যেতো বলে জানিয়েছেন তিনি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানিয়েছেন, খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। সরকার রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য সহজ পথে গেছে। শুল্ক-কর বাড়ানোর ফলে শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর জীবনে বেশি প্রভাব পড়ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, আগামী বাজেটে ভ্যাটের বিষয়টি সংশোধন করা হবে। তখন পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। ভ্যাট বাড়ানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে ভ্যাট ছাড় থেকে বেরিয়ে আসা।

অনেক খাতেই অনেক দিন ধরে ভ্যাট ছাড় চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব আর উৎসাহিত করতে চাই না। এই প্রক্রিয়ায় কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে এবং কিছু মানুষের কষ্ট হচ্ছে। আপাতত লক্ষ্য হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা যায়, ততটা নিয়ন্ত্রণ করা।’





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত