Homeঅর্থনীতিভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে কার স্বার্থে

ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে কার স্বার্থে


মূল্যস্ফীতি এখনও বাড়তির দিকে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন অনেকটাই হাঁসফাঁস অবস্থা। বিগত সরকারের আমলে শুরু হওয়া মানুষের এই কষ্ট একফোঁটাও কমেনি। এমন পরিস্থিতির মাঝে নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর সিদ্ধান্তে সর্বত্রই সমালোচনা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদসহ অনেকেই বলছেন, সরকার রাজস্ব বাড়াতে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও এতে রাজস্ব আরও কমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া অজনপ্রিয় এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়তে পারে। এদিকে এক মাস না যেতেই মানুষের ব্যাপক সমালোচনা ও ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে কয়েকটি খাতে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সর্বশেষ সোমবার (২০ জানুয়ারি) ওয়ার্কশপের ওপরে আরোপিত ভ্যাটের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে এনবিআর। অর্থাৎ মোটরসাইকেল গ্যারেজ বা গাড়ির ওয়ার্কশপের ভ্যাট আগের মতো ১০ শতাংশই থাকবে। এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি হোটেল, রেস্তোরাঁ খাতে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে এনবিআর। এছাড়া মোবাইলে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহারসহ তথ্যপ্রযুক্তি সেবার ওপর ২৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে আগের মতো ২০ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। একইভাবে রেস্তোরাঁর খাবারে বিলের ওপর ১৫ শতাংশের পরিবর্তে আগের মতো ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর পোশাক, মিষ্টি, নন-এসি হোটেলসহ বেশ কিছু খাতের ভ্যাট হার কমিয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। এসব খাতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছিল।

সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্সের জেরে জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষও  এই ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপের কারণে কাহিল হয়ে পড়েছে। কারণ, মানুষের আয় বাড়ছে না, অথচ ব্যয় যখন বেড়েই চলছে, তখন সরকারের এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী বলে এরই মধ্যে বলা শুরু হয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে। সামনে পবিত্র রমজান মাস। ফলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এবারের রমজান মাসে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ও খরচ আরও বাড়বে। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেসব পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে, তার কোনও প্রভাব পড়ছে না ক্রেতা পর্যায়ে। এর মধ্যে নতুন করে শুল্ক-কর বাড়ানোর ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে। এই ব্যয় অন্তত ১৫ শতাংশ বাড়তে পারে।’

সম্প্রতি অর্থনৈতিক বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস্তবে মূল্যস্ফীতির হার ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ। যদিও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৩৪ শতাংশ। তার আগের বছর ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৯.৪৮। গত বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল মানুষ। সে তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি।

ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৯২ শতাংশ। আর সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ১০.৮৯ শতাংশ। অথচ জাতীয় মজুরি হার কয়েক মাস ধরেই ৮ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। মূল্যস্ফীতির তুলনায় মানুষের আয় কম হারে বাড়ায় মানুষের কষ্ট বাড়ছে।

বাজারের চিত্র বলছে,  ইতোমধ্যে চাল-ডাল থেকে শুরু করে মাছ, মাংস—সব কিছুতেই দাম বাড়ানোর যে প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে সাধারণ মানুষের টিকে থাকাই  কঠিন হয়ে উঠেছে।

বর্তমান বাস্তবতায় ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোকে ‘অবিবেচকের’  হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো এবং শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

শনিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা আশ্চর্য হয়েছি, কীভাবে অবিবেচকের মতো ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেকোনও একটি দেশে যদি আপনি কর সংগ্রহ করতে চান, তাহলে ক্রমান্বয়ে তাকে প্রত্যক্ষ করের কাছে যেতে হবে। আমরা দেখলাম না কোনও প্রত্যক্ষ কর আহরণের জন্য পরিকল্পনা।’

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘যাদের টিআইএন আছে, কিন্তু যারা ট্যাক্স দেন না—তাদের প্রতি কী আচরণ করা হবে তা কিন্তু কোনও পরিকল্পনায় নেই।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তারও মনে করেন, সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাটের হার বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে হলে রাজস্বের আওতা বাড়তে হবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়তে হবে।

প্রসঙ্গত, ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তির শর্ত হিসেবে আইএমএফ চলতি অর্থবছর বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে বলেছে। সে কারণে অর্থবছরের মাঝপথে এসে এভাবে হঠাৎ ভ্যাটের বোঝা সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে এনবিআর।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় সরকারের ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর তালিকায় এমন অনেক পণ্যসেবা আছে, সেখানে সাধারণ মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’ তার মতে, বিরূপ প্রভাব শুধু গরিবের ওপরই পড়বে না, মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপরও চাপ পড়বে। এটা সাধারণ মানুষকে চাপের মধ্যে ফেলবে । তিনি বলেন, ‘সামর্থ্যবান অনেকেই সঠিকভাবে কর দেন না। সেখানে হাত দেওয়া উচিত ছিল।’

ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির কারণে সারা দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোগ বড় রকমের চাপের মধ্যে পড়েছে। দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এখন হতাশ। অথচ সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করেন এসব উদ্যোক্তা। তাদের বেশিরভাগই সামনের দিনগুলোতে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কিনা, এটা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন। এসব ব্যবসার সঙ্গে নির্ভরশীল পরিবারগুলোও বড় রকমের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেছেন, আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভ্যাট ও ট্যাক্স বাড়ানোর উদ্যোগ কোনোভাবেই কাম্য নয়।  সোমবার (২০ জানুয়ারি) সচিবালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সৌজন্য সাক্ষাৎকালে চাকা চেম্বারের সভাপতি এমন মন্তব্য করেন।

এদিকে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্য হিতে বিপরীত হতে পারে বলে মনে করছেন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা। তারা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক এবং গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ভোক্তার স্বার্থবিরোধী উল্লেখ করে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের ওপর ভ্যাট ও করের বোঝা চাপালে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের শ্রমজীবী, প্রান্তিক কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষ। যে হারে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে তাতে বিস্কুট, কেক, জুসসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। আর ভোক্তা না থাকলে খাদ্যপণ্যের বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে এরই মধ্যে এ খাতের আড়াই লাখ শ্রমিকের কাজ হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সদস্যরা এসব উদ্বেগের কথা জানান।

অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক আরোপিত কর ও ভ্যাট জনগণের ভোগান্তি আরও বাড়াবে বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি। শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ সরকারের সিদ্ধান্ত ‘অপরিণামদর্শী’ অভিহিত করে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে দলটি। রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপে সাধারণ মানুষের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন।

এদিকে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রথম চার মাস শেষে শিল্পের প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম চার মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানির ‘এলসি সেটেলমেন্ট’ কমেছে ১৩ শতাংশ। এই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬৬। সাড়ে তিন বছরের মধ্যে এই হার সর্বনিম্ন।

সিগারেটের দাম বাড়লেও রাজস্ব কমতে পারে

সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাজারে অবৈধ সিগারেটের জোগান বাড়াবে এবং দীর্ঘমেয়াদে সরকারের রাজস্বের ক্ষতি করবে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ সিগারেটের বাজার বেড়ে রাজস্ব কমবে।তাদের মতে, সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে বাজারে চাহিদা কমবে এবং কমে আসবে সরকারের রাজস্ব আয়। তারা মনে করেন, সিগারেটের দাম বাড়ার কারণে অবৈধ সিগারেটের বাজার বড় হতে পারে; যা রাজস্ব আয়কে আরও সংকুচিত করবে। ইতোমধ্যে প্রায় সব ধরনের সিগারেটের দামই শলাকাপ্রতি বেড়েছে এক থেকে দুই টাকা।

উল্লেখ্য, সিগারেটসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ৯ জানুয়ারি থেকে শুল্ক ও কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ইতোমধ্যে নতুন মূল্যের ভিত্তিতে স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোল ব্যবহারের নির্দেশনা জারি করেছে। ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) সম্প্রতি তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করে শুল্ক ও কর বৃদ্ধি ব্যবসা খাত ও বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত