জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বেশ কয়েকটি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দিয়েছে, যা বাজার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ তালিকায় রয়েছে দেশে উৎপাদিত বিস্কুট, লবণ, সরিষার তেল, আটা, ময়দা, এলপি গ্যাসসহ বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। কিছু পণ্যে উৎপাদন পর্যায়ে ও কিছুতে ব্যবসায়ী পর্যায়ে এ ছাড় দেওয়া হয়েছে। গত রোববার এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান স্বাক্ষরিত গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। গতকাল সোমবার এনবিআর এ তথ্য নিশ্চিত করে।
এনবিআরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, র্যাপসিড অয়েল, কোলজা সিড অয়েল, ক্যানোলা অয়েলের উৎপাদন পর্যায়ে এবং দেশে উৎপাদিত সানফ্লাওয়ার সিড অয়েল (রিফাইন্ড), র্যাপসিড অয়েল, কোলজা সিড অয়েল, ক্যানোলা অয়েল, সরিষার তেল ও চালের কুঁড়ার তেলের (রাইস ব্র্যান অয়েল) ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই সুবিধার মধ্যে র্যাপসিড অয়েল, কোলজা সিড অয়েল ও ক্যানোলা অয়েলের উৎপাদন পর্যায়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি থাকবে। তবে সরিষার তেলের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, দেশে সয়াবিন তেলের বিকল্প ব্যবহারে উৎসাহিত করতে এসব তেলে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে এনবিআরের প্রজ্ঞাপনে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত মানার কথা বলা হয়েছে, যেমন ভ্যাট নিবন্ধন, চালান ইস্যু, রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ ও মাসিক ভ্যাট রিটার্ন দাখিল।
এনবিআরের ঘোষণার মধ্যে আরও উল্লেখ রয়েছে, দেশে উৎপাদিত শুকনো শিম্বাকার শাকসবজি, খোসা ছাড়ানো বা দ্বিখণ্ডিত ডাল, দেশে উৎপাদিত গুঁড়া মরিচ, ধনে, আদা, হলুদ ও মসলার মিশ্রণ; দেশে উৎপাদিত আটা, ময়দা ও সুজি; দেশে উৎপাদিত বিস্কুট, দেশে উৎপাদিত লবণ ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত হার্বিসাইডসের ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি শর্ত সাপেক্ষে এলপি গ্যাসেও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে যাঁরা আমদানি করে সরাসরি ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করেন, তাঁরা এ সুবিধা পাবেন না।
এনবিআর জানিয়েছে, ভ্যাট ও শুল্ক পুনর্নির্ধারণের উদ্দেশ্য দেশের আর্থিক ভিতকে শক্তিশালী করা এবং অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধি করা। গত জানুয়ারিতে এনবিআর শতাধিক পণ্যে নতুন করে ভ্যাট আরোপ করলেও পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে কয়েকটি পণ্যে শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। উদাহরণস্বরূপ ৯ জানুয়ারি বিস্কুট ও কেকের ভ্যাটের হার ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল, যা পরে ২০ ফেব্রুয়ারি সংশোধন করে বিস্কুটের ক্ষেত্রে সাড়ে ৭ শতাংশ কমানো হয়।
এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা আল-আমিন শেখ বলেন, জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার এসব পরিবর্তন এনেছে। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল সমাজ ও অংশীজনদের অনুরোধে এবং রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ও র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক এনবিআরের এই পদক্ষেপকে সময়োপযোগী বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, যেহেতু এসব তেল ও খাদ্যপণ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল; তাই ভ্যাট অব্যাহতির সুফল তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া সয়াবিন তেলের বিকল্প হিসেবে এসব তেল কতটুকু ব্যবহার করা হবে, সেটাও বিবেচনার বিষয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষ আসলে কতটা উপকৃত হবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
এদিকে পৃথক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এনবিআর ক্যানসারের ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে উৎসে কর ৫ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করেছে। এর ফলে ক্যানসার চিকিৎসার ব্যয় কিছুটা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত ১৫ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এনবিআরকে ক্যানসারের ওষুধের দাম কমানোর পাশাপাশি মাল্টিভিটামিন ও মাল্টিমিনারেল ওষুধের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আরও জানিয়েছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সরকার বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক ছাড় দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভোজ্যতেল, চিনি, আলু, ডিম, পেঁয়াজ, চাল, খেজুর ও কীটনাশকের ওপর আমদানি শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি, ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর ও আগাম করের ক্ষেত্রে করছাড়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য ই-বুক সেবার স্থানীয় সরবরাহ ও আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যানজট নিরসনে মেট্রোরেল সেবার ওপরও ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি হজযাত্রীদের খরচ কমাতে হজ টিকিটের ওপর আবগারি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এনবিআরের এই উদ্যোগগুলো সামগ্রিকভাবে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ও সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের গতি ও বাজারে এর প্রতিক্রিয়ার ওপর।