সরকারের ছয় মাস অতিবাহিত হলেও দেশের ব্যবসা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কবে কাটবে— এই আশায় অপেক্ষা করছেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত নতুন করে বিনিয়োগে কেউ যেতে চাইছেন না। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এখন দ্বিধাগ্রস্ত। এমন পরিস্থিতির মাঝে নতুন করে ভ্যাট আরোপ ও সরকারের নীতির ধারাবাহিকতার অভাবে ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন করে সমস্যায় পড়েছেন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা। সরকারের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি খাতে নতুন করে দেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। আবার দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ব্যাপকহারে কমেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (প্রথম ৬ মাসে, জুলাই-ডিসেম্বর) উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৬৭.১১ শতাংশ। অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছে ২.২৯ বিলিয়ন ডলার– যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬.৯৮ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসের অর্থছাড়— গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, এসময় বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ৩.৫৩ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪.০৬ বিলিয়ন ডলার।
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে— ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ৭১ শতাংশ কম বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে ১০৪ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আগের বছরের একই সময়ে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগ ছিল ৩৬০ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। এরপর এসেছে দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন থেকে।
এদিকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সাম্প্রতিক ‘এফডিআই হিটম্যাপ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী— দেশীয় শিল্পের জন্য কাঠামোগত বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে প্রচারণার ঘাটতি আছে।
শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে গার্মেন্ট খাতে উৎপাদন খরচ ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ব্যাংক সুদের হারও বেড়ে গিয়ে ১৪-১৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা শিল্প কারখানাগুলোর জন্য অর্থনৈতিক চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া বর্তমানে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যার ফলে পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্প খাতে খরচ আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস সরবরাহের অপ্রতুলতা অনেক শিল্প কারখানায় উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ এবং সাভারের শিল্প এলাকাগুলোতে। এখানে গ্যাস সংকটের কারণে ৫০-৬০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে।
অর্থনৈতিক এই দুরবস্থায় বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। রাজনৈতিক পালাবদল কোন দিকে যায়, তা দেখার জন্য বিনিয়োগকারীরা এখন অপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দ্রুত সমাধান করা না হলে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ হারাতে পারে। এতে দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক লক্ষ্য ও প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অবশ্য অর্থনীতিবিদরা গত কয়েক বছর ধরে অর্থনীতিকে গতিশীল করতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসলেও গত দুই থেকে তিন বছর ধরেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করা হয়েছে। বিশেষ করে গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে দেশে অস্থিতিশীলতা থাকায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মহাসচিব আল মামুন মৃধা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিরাজমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। এছাড়া সুদের বাড়তি হার ও শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহের ঘাটতির কারণেও বিদেশি বিনিয়োগ কমছে।’
বিদেশি বিনিয়োগের উন্নতির জন্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য বলে মনে করেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকা ও নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে বর্তমান পরিবেশ বিনিয়োগের অনুকূল নয়।’
সোমবার (২৭ জানুয়ারি) বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বৈশ্বিক ও দেশের অভ্যন্তরীণ নানা কারণে গত ছয় মাসে ইপিজেডগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২২ শতাংশ কমে গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বেপজা সদস্য মো. আশরাফুল কবীর জানান, ২০২৪ সালে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বেপজার সঙ্গে ২৮টি নতুন বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠানের মোট প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ৫৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এ পর্যন্ত বেপজার ইপিজেডগুলোতে ৩৮টি দেশ থেকে বিনিয়োগ এসেছে। সবচেয়ে বেশি এসেছে চীন থেকে। চীনের মোট ১০৮টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে ইপিজেডে। এরপর বিনিয়োগ করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ৬১টি, জাপানের ২৯টি, ভারতের ১৯টি, যুক্তরাজ্যের ১৯টি, যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি ও শ্রীলঙ্কার ৭টি প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে আটটি ইপিজেড ও বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চলে মোট ৪৪৯ শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। এর মধ্যে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ২৫৮টি, যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ৪৯টি ও শতভাগ দেশীয় প্রতিষ্ঠান ১৪২টি।