Homeঅর্থনীতিবন্ধের শঙ্কায় পানগাঁও বন্দর

বন্ধের শঙ্কায় পানগাঁও বন্দর


চট্টগ্রাম-পানগাঁও নৌপথে কনটেইনার পরিবহন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এই রুটে জাহাজ চলাচল আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এতে পানগাঁও বন্দরের ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনালে (আইসিটি) কনটেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে ভাটা পড়েছে। একসময় যে রুটকে বিকল্প সমাধান হিসেবে দেখা হয়েছিল, এখন তা প্রায় নিষ্ক্রিয়। এই নৌপথকে চাঙা করতে একের পর এক বৈঠক, সিদ্ধান্ত, উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত সুফল আসছে না।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, উচ্চ ভাড়া, ভুল টার্মিনাল নির্বাচনের কারণে আমদানিকারকেরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। অন্যদিকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটমুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে চাইছে। তাহলে কি এই রুট ফের সচল হবে, নাকি আরও অচলাবস্থার দিকে যাবে, এটাই এখন বড় প্রশ্ন।

সংকটের যে প্রভাব

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পানগাঁও বন্দরের অবস্থানগত সমস্যা, কনটেইনার ভাড়ার উচ্চ হার এবং কাস্টমস জটিলতার কারণে আমদানিকারকেরা এই রুটে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া রেল ও সড়কপথের তুলনায় বেশি, যা ব্যবসায়ীদের জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। ২০২৩ সালে এই রুটে ১৪৭টি জাহাজ চলাচল করলেও ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ১৬টি জাহাজ চলেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে একটিও চলেনি। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পানগাঁও বন্দরে ৩ হাজার ৩৪ টিইইউস (ট্রেন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কনটেইনার হ্যান্ডলিং হলেও ২০২৪ সালের জুন মাসে তা কমে মাত্র ১৪৯ টিইইউসে দাঁড়িয়েছে।

সংকট নিরসনে বৈঠক ও সিদ্ধান্ত

গত ২৬ জানুয়ারি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুট সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের নির্ধারিত ভাড়ার সার্কুলার প্রত্যাহার করে প্রতিযোগিতামূলক ভাড়া নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ফলে জাহাজমালিকেরা দর-কষাকষির মাধ্যমে ভাড়া নির্ধারণের সুযোগ পাবেন, যা ব্যয় কমাবে এবং সেবার মান বাড়াবে।

বৈঠকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব, যুগ্ম সচিব, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল এ প্রসঙ্গে বলেন, ভাড়াসংক্রান্ত আগের সার্কুলার বাতিল হওয়ায় এখন প্রতিযোগিতামূলক ভাড়া নির্ধারণ করা যাবে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য ইতিবাচক হবে।

মূল সমস্যাগুলো

ব্যবসায়ীদের দাবি, রুটটির মূল সমস্যা হলো—পানগাঁও টার্মিনাল কেরানীগঞ্জে হওয়ায় ঢাকার উত্তরাঞ্চলের শিল্পকারখানার সঙ্গে এর সংযোগ দুর্বল। এতে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয়ে পড়েন। নদীপথের কনটেইনার পরিবহন খরচ সড়ক ও রেলপথের তুলনায় বেশি, যা আমদানিকারকদের নিরুৎসাহিত করছে। ২০ ফুট সাইজের একটি কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া ২০০-২৫০ ডলার। কাস্টমস কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত হয়রানির অভিযোগ রয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের পণ্য খালাসে অনীহা সৃষ্টি করছে।

ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া

গত বছরের ৬ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরের মালিকানাধীন ‘পানগাঁও এক্সপ্রেস’ জাহাজ ডুবে যাওয়ার পর এই পথে পণ্য পরিবহনে আরও ধস নামে। মায়ের্কস লাইন, যাদের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে পানগাঁও রুটে প্রায় অর্ধেক পণ্য পরিবহন হয়, তাদের কার্গো পরিবহনের পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। একসময় প্রতি মাসে ৪০০ টিইইউস কনটেইনার পরিবহন করা হলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ৩০ টিইইউসে।

শিপিং কোম্পানি সি গ্লোরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন জুয়েল বলেন, শুধু জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনা নয়, বরং কাস্টমসের হয়রানি ও উচ্চ ভাড়ার কারণে ব্যবসায়ীরা বিকল্প পথ খুঁজছেন।

পানগাঁও কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. সাখাওয়াত আলী সাদি স্বীকার করেন, কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমার দুটি প্রধান কারণ রয়েছে—উচ্চ ভাড়া এবং জাহাজ চলাচলের নির্দিষ্ট কোনো সূচি না থাকা। তিনি জানান, এ সমস্যা সমাধানে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

সমাধানের উদ্যোগ

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সংকট নিরসনে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পানগাঁও বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়াতে ৬ দফা সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন এবং সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গত বছরের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরে স্টেকহোল্ডার মিটিংয়ে কাস্টমস ও ট্যারিফ-সংক্রান্ত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক করতে সরকার প্রতিযোগিতামূলক ভাড়াব্যবস্থা চালু, কাস্টমস জটিলতা নিরসন এবং পানগাঁও বন্দরের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে এই রুট আবারও লাভজনক হয়ে উঠবে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত