আসছে অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ জানিয়েছে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)।
আজ মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘বাজেট প্রস্তাবনা ২০২৫-২৬’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই বাজেট প্রস্তাব লিখিত আকারে ২৮ ধরনের সুপারিশ অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী ও অর্থসচিব নাজমা মোবারেক উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আইএমএফের ঋণ না পেলে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ঋণের অর্থও পাওয়া যাবে না।
ইআরএফ বলছে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের আগেই ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানো ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা জরুরি। কারণ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের একটি ধাক্কা অর্থনীতিতে পড়বে। এ সময় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনীতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে ইআরএফ জানিয়েছে, শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে এ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এজন্য বাজার ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ চেইনে বিদ্যমান সিন্ডিকেট ভাঙা ও সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধেও সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে বাজেটে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়সীমা অন্তত ৫ লাখ টাকা করা।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে দরিদ্রদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সরকার ওপেন মার্কেট সেল বাড়িয়েছে, যা প্রশংসাযোগ্য। এ ধারা আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখা জরুরি। একই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতার উপকারভোগী ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করছে ইআরএফ।
আমরা লক্ষ করছি, বিপুল পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ এবং ভর্তুকির চাপে সরকারের পরিচালন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, কয়েক বছর ধরে উন্নয়ন ব্যয় বাড়ছে না। তাই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ করে ব্যয় করার ক্ষেত্রে সরকারের আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে ইআরএফ মনে করে।
কর পরিশোধিত আয় থেকে একজন ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে মুনাফার ওপর ১০-১৫ শতাংশ কর কাটা হয়। আবার ব্যাংকের জমা স্থিতির ভিত্তিতে আবগরি শুল্ক কাটা হয়। এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় সক্ষমতা কমেছে। আবার বিভিন্ন ভীতির কারণে অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইছেন না। এ রকম অবস্থায় ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমার ওপর আবগরি শুল্ক প্রত্যাহার এবং মুনাফার ওপর কর কমানো যেতে পারে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার মান সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। সরকারের নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি সাধারণ মধ্যবিত্তরাও এখন বাংলাদেশি স্বাস্থ্যসেবার ওপর আস্থা হারিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য ছুটছেন। এ অবস্থায় দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের প্রতিটিতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের স্ট্যান্ডার্ডে একটি করে হাসপাতাল স্থাপন করতে আগামী বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে।
ক্যানসারসহ দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ককর প্রত্যাহার করা এবং ধারাবাহিকভাবে ওষুধের দাম ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি বাড়ছে, যা বহনের ক্ষমতা দেশের বেশির ভাগ মানুষের নেই। বাংলাদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার ৭২ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর দেশের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। ওষুধের দাম ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যয় কেন এত বাড়ছে, তা সরকারের খতিয়ে দেখা দরকার। আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার কমিয়ে আনার সুপারিশ করছি।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থার জনবলকে এখনো ১ থেকে ২ টাকা কেজি দরে তেল, চিনি, মসুর ডালসহ বিভিন্ন রেশন পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যদিকে, অতিদরিদ্রদের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে বিতরণ করা খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ অবস্থায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির পণ্যমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে রেশন পণ্যের দাম বাড়ানো যেতে পারে।
ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে গতি নেই। ফলে বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বিভিন্ন শিল্পকারখানা বন্ধের কারণে উল্টো লাখো শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ছে। কর্মসংস্থান ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে বাজেটে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কোন খাতে কোন ধরনের সংস্কার হবে, তার প্রভাব অর্থনীতি ও জনজীবনে কতটা পড়বে—সে সম্পর্কে কেউ ধারণা করতে পারছেন না। তাই সরকার তার মেয়াদে কোন কোন সংস্কার করতে আগ্রহী এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব কী হবে, তা বাজেট বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষাকে সহজলভ্য এবং যথাসম্ভব সাশ্রয়ী করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বিদেশি বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। অন্যদিকে, দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশিরা চাকরি পাচ্ছে না। প্রয়োজনে পিপিপির মাধ্যমে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বেসরকারি খাতে মিডলেভেল ম্যানেজমেন্টের উপযোগী জনবলকে দক্ষ করে তুলতে হবে।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন সামনে রেখে রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যেহেতু বেশি দিন রপ্তানিতে ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হবে না, তাই সম্ভাবনাময় পণ্যগুলোকে প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে প্রমোট করে রপ্তানি উৎসাহিত করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন সামনে রেখে বেসরকারি খাতের সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দসহ কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রেডিক্টেবল রাজস্বনীতি ঘোষণা করার পাশাপাশি ব্যবসার পরিবেশ সহজ করার ওপর জোর দিতে হবে।